রাজু আহমাদ, শালিখা (মাগুরা) প্রতিনিধি:
শীতকালের কথা বলতেই যেসব জিনিসের কথা মনে পড়ে, তার মধ্যে খেজুরের রস অন্যতম। শীত মানেই যেন খেজুরের রস।পৌষ মাস আসলেই খেজুর গাছ কাটতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন গাছিরা।পৌষ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত রস সংগ্রহের মৌসুম।এই তিন মাসে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা বিক্রি করতে নিরলস সময় পার করেন গাছিরা।সাথে রস দিয়ে তৈরি গুড়-পাটালি বিক্রির ধুম চলে সমানে।
রস অল্প জ্বালিয়ে তাতে ভেজানো হয় চিতই পিঠা, করা হয় রসের পায়েস। রস জ্বালিয়ে বানানো হয় গুড়। রস ঘন হতে শুরু হলে সেই রস তুলে তা দিয়ে মুড়ি, খই ও চিড়ার মোয়া বানানো হয়। খেজুরের গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা বানানো হয়। শীতের সকালে রসে ভেজা রসচিতই বা গরম গরম ভাপা পিঠা শীতের সকালের ক্লান্তি দূর করে মনকে রাঙিয়ে দেয়।
রসের মৌসুম আসলেই গাছিরা এক মৌসুমে পঞ্চাশ থেকে লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন।ফলে খেজুর গাছের মাধ্যমে একদিকে যেমন রসগোল্লা পাতালের চাহিদা পূরণ হয় অপরদিকে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল হয়।
তবে বর্তমানে শালিখার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে খেজুর গাছ।গ্রামীণ সড়কে এখন আর আগের মতো খেজুর গাছের সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য চোখে পড়ে না।অন্য দিকে নতুন প্রজন্মের শিশুরাও শীতের সকালের খেজুর গাছের রস, গুড় ও পিঠার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক নগরায়ন ও অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদের পাহাড়ের রাণী খ্যাত খেজুর গাছ এবং এটির রস।এতে করে কমেছে গাছির সংখ্যাও।
কয়েক বছর আগেও হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটার হিড়িক পড়ত শালিখা উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে।গ্রামের পথে-ঘাটে, নদী বা পুকুরপাড়ে, বড় রাস্তার দু’পাশে বা ক্ষেতের সীমানা ঘেঁষে শত শত গাছের মাথার নরমাংশ বিশেষভাবে কাটতেন গাছিরা।১৫-১৬টি পাতা রেখে গাছের উপরিভাগের বাকলসহ অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিষ্কার করে গাছের অগ্রভাগে নল বসিয়ে মাটির পাতিল ঝুলিয়ে রস সংগ্রহ করা হতো।আড়াআড়িভাবে বাঁধা বাঁশের খণ্ডে দাঁড়িয়ে কোমরে ও গাছে রশি বেঁধে ধারালো দা দিয়ে গাছিদের গাছ কাটার দৃশ্য ছিল দেখার মতো।কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই দৃশ্য এখন তেমন চোখে পড়ে না।
বেশ চড়া দামে ইটভাটার মালিকদের কাছে খেজুর গাছ বিক্রি করা, নতুন করে খেজুর গাছ রোপণ না করা এবং গ্রামীণ সড়কের সংস্কার কাজের কারণেও অনেক স্থানে খেজুর গাছ উজাড় হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
শালিখা উপজেলার শতখালী ইউনিয়নের সিংহেস্বরপাড়ার আব্দুল কুদ্দস বলেন, ৩০ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটতেছে, আগে এক সময় তিন থেকে চারশ গাছ কাটতাম কিন্তু এখন গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতি মৌসুমে ৫০ থেকে ৬০ টি গাছ কাটা হয়।
আব্দুল কুদ্দুস আরো বলেন, এখনো অধিকাংশ মানুষ সকাল হলে আমার বাড়িতে আসে খেজুর রস নেওয়ার জন্য এক হাড়ি রস বিক্রি করি ৩০০ টাকা এবং এক কেজি পাটালি ও ঝোলগুড় বিক্রি করি ২শ থেকে ৫শ টাকা।তারপরও লোকজন লোকজনের চাহিদা অনুসারে ঠিকমতো দিতে পারি না।গাছ বেশি হলে প্রতি মৌসুমে ৫০ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকা আয় করা যায় বলে জানান আব্দুল কুদ্দুস।
আড়পাড়া ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের তাহাজ্জৎ কাজী বলেন, এক সময় অনেকগুলো গাছ কাটতাম।এখন ২০-৩০ টা মত গাছ কাটি তা থেকে যে রস হয় তা সকালবেলা লোকজন বাড়ির উপর এসে নিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে শ্বপন, শামসুল, সাধনসহ কয়েকজন গুড় ও পাটালি বিক্রেতার সাথে কথা হলে তারা জানান, খেজুরের রস পর্যাপ্ত না থাকায় এখন অধিকাংশ জায়গায় চিনি মিশ্রিত গুড়-পাটালি বিক্রি করা হয়।এছাড়াও খেজুর রসের অভাবে গ্রাম অঞ্চলের মহিলারা এখন রসের বদলে চিনি ও পানি মিশিয়ে ভিজা পিঠা তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।
শালিখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আলমগীর হোসেন বলেন, শালিখা উপজেলায় ২৬ হাজার খেজুর গাছ আছে।যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম তাই এই গাছের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করতে সবাইকে খেজুর গাছ বেশি বেশি রোপন করা প্রয়োজন পাশাপাশি যে গাছগুলো আছে সেগুলো নির্বিচারে কর্তন না করে পরিচর্যা করা প্রয়োজন।তাহলেই খেজুর গাছের মাধ্যমে চাহিদা মাফিক রস, গুড় ও পাটালি পাওয়া সম্ভব হবে।