সুন্দরবনে চলছে হরিণ শিকারের মহোৎসব

Spread the love

মোঃ বায়জিদ হোসেন।
কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি।

অসাধু বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে এসব হরিণ শিকার করছে পাচারকারীরা। এতে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ, হরিণ অস্তিত্ব হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের হরিণসহ সব বন্যসম্পদ রক্ষায় আরও কঠোরভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে।

এসব পাচারকারীকে ধরতে প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে বুধবার (১৯ জুলাই) ভোরে খুলনার কয়রা থেকে হরিণের ৫৩ কেজি মাংস উদ্ধার করেছে পুলিশ। উপজেলার ৪ নম্বর কয়রায় শাকবারিয়া খালের পাশে অভিজান চালিয়ে এ মাংস উদ্ধার করা হয়। তবে খালে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায় পাচারকারী।

উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলায় হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। গত তিন মাসে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৩২ কেজি হরিণের মাংস, একটি গলাকাটা হরিণ, পাঁচটি চামড়া ও মাথা জব্দ করে প্রশাসন। এ সময়ে মামলা হয়েছে ১০টি, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬ জন। গত এক বছরে এর সংখ্যা ৫০ জনের বেশি। সম্প্রতি তিন মণ হরিণের মাংসসহ এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল কয়রা উপজেলা পরিষদের সম্মেলনকক্ষে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় নির্বিচারে হরিণ নিধনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পায়।

জানা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই চিত্রা হরিণ। কিন্তু দিনের পর দিন প্রশাসনের রেড এলার্ডসহ বিভিন্ন অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হরিণ নিধন করে যাচ্ছে পাচারকারীরা।

স্থানীয়রা বলছেন, সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় দাম কম হওয়ায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বেড়েছে। এ সুযোগে গত কয়েক মাস ধরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পাচারকারীরা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি চক্র অনেক আগে থেকেই হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত। বন বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অগ্রিম ‘দাদন’ নিয়ে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকে চোরা শিকারিরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে ‘এজেন্ট ব্যবসায়ীদের’। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম, আবার কখনো মাংস এনেও বিক্রি করা হয়। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানেও পৌঁছে যায় হরিণের মাংস।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বন্যপ্রাণি শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া জব্দ হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হরিণ শিকার হয়।

অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির আরও বলেন, মাঝে মধ্যে দু-একটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা জব্দ হলেও মূল চোরা শিকারি ও পাচারকারীরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েকদিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হন।

তিনি আরও বলেন, বনে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য রাখতে সব প্রাণিরই প্রয়োজন। কোনো একটি না থাকলে সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়।

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা সোলায়মান গাজী বলেন, সুন্দরবন প্রভাবিত কয়রার গ্রামগুলোতে বেশিরভাগই শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ উপজেলার ৩০টির বেশি চোরা শিকারি চক্র নির্বিচারে সুন্দরবনের হরিণ নিধন করছে।

কয়রার ইউএনও মো. মমিনুর রহমান বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রায় সুন্দরবনকেন্দ্রিক অপরাধপ্রবণতার চিত্র তাদের উদ্বিগ্ন করেছে। তিনি আরও বলেন, বিশেষত হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্য রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেনের ভাষ্য, অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বন বিভাগের। তারপরও হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে। র‌্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বন বিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে এখন বনে হরিণ শিকারের সুযোগ কম। তাছাড়া সম্প্রতি বন্য প্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীদের পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণার ফলে চোরা শিকারীদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ উৎসাহিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *