মশিউর মিলন, পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধি:
চিকিৎসক সংকটে দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রসূতি অস্ত্রোপচার কক্ষ। বন্ধ রয়েছে প্রসূতিদের সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার। আর এতে বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রসূতিরা। অযত্ন অবেহলা ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অস্ত্রোপচার (অপারেশন থিয়েটার) কক্ষে থাকা কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের শুরুর দিকে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনে মা ও প্রসূতি ইউনিটে স্থাপন করা হয় অত্যাধনিক প্রসূতি অস্ত্রোপচার (অপারেশন থিয়েটার) কক্ষ। ওই বছরের ২৩জুন শুরু হয় প্রসূতি অস্ত্রোপচার। সর্বশেষ অস্ত্রেপচার হয় একই বছরের ২৭জুলাই। সেপ্টম্বর মাসে গাইনি বিশেষজ্ঞ ও সার্জন নুপুর আক্তার অন্যত্র বদলি হয়ে যায়। এর কিছু দিন পর অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক জামশেদও বদলি হয়ে যান। এতে অত্যাধুনিক অস্ত্রোপচার কক্ষ চালুর ১ মাস না যেতেই বন্ধ হয় প্রসূতি অস্ত্রোপচার। নতুন কোনো গাইনি বিশেষজ্ঞ (সার্জন) ও অবেদনবিদ (অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ) যোগদান না করায় দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপারেশন থিরেয়টার (ওটি)।
দেশ চ্যানেল সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনের ২য় তলায় ২১২ নম্বর কক্ষে অবস্থিত প্রসূতি অস্ত্রোপচার কক্ষের দরজায় তালা ঝুলছে। দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ থাকায় অযত্ন অবহেলায় পরে রয়েছে কোটি টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রাপাতি ও সরঞ্জাম। কার্যক্রম না থাকায় ধুলো বালি জমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এসব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, হাসপাতালে প্রসূতি অস্ত্রোপচার না হওয়ায় হাসপাতালের অদূরে ও উপজেলার আনাচে কানাচে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে নামসর্বস্ব বিভিন্ন ক্লিনিক। এসব ক্লিনিকে চলছে রমরমা সিজারিয়ান অপারেশন ব্যবসা। সরকারি হাসপাতালে কম খরচে সিজারিয়ান অপারেশন চালু হলে ক্লিনিক ব্যবসায় ভাটা পরার শঙ্কায় মালিক পক্ষ বিভিন্ন মহল ম্যানেজ করে হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ পদটি শূন্য রেখেছেন। অপরদিকে স্বাস্থ্য বিভাগের তদারকি না থাকায় এসব ক্লিনিকে হাতুড়ে চিকিৎসক দিয়ে চলছে প্রসূতি অস্ত্রোপচার। এতে প্রায়ই ঘটছে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা।
চলতি বছরের গত ২৬আগস্ট উপজেলার কালিশুরী বন্দরের মাজেদা মেমোরিয়াল ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় মোসা. লিমা আক্তার নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। একই ক্লিনিকে ২০২০ সালে হ্যাপী বেগম নামে অপর এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। কালিশুরী বন্দরে অবস্থিত নিউ লাইফ কেয়ার ক্লিনিকে ২০২১ সালে সাথী আক্তার নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। এঘটনায় মামলাও করেন নিহতের পরিবার।
২০১৯ সালের ২এপ্রিল উপজেলার কালাইয়া লঞ্চঘাট এলাকায় সাহেদা গফুর হাসপাতালে অস্ত্রোপচার কক্ষে জুলিয়া বেগম নামের এক প্রসূতি নারী ও তার নবজাতকের মৃত্যু হয়। অদক্ষ চিকিৎসক দিয়ে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করায় ওই প্রসূতির মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অদূরে নিরাময় ক্লিনিকে ২০১৭ সালে মাকসুদা নামে এক প্রসূতি নারীর পেটে গজ রেখেই অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন চিকিৎসক অর্জুন। পরে জানা যায় কোনো ডিগ্রি ছাড়াই নিজেকে চিকিৎসক দাবি করে সিজারিয়ান অপারেশ করে আসছিলেন ওই ভূয়া চিকিৎসক। বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আসলে প্রসূতি নারীকে ৯লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দেন উচ্চ আদালত। পরে ক্লিনিকটি নাম পরিবর্তন করে বাউফল হেলথ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক সেন্টার এন্ড ক্লিনিক নামে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থিত সেবা ক্লিনিক। সেবা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় একাধিক প্রসূতি মৃত্যু অভিযোগ রয়েছে। ২০১৫ সালের ৮ডিসেম্বর মরিয়ম বেগম, ২০২০ সালের ১৫সেপ্টেম্বর রিপা রানী, ২০২১ সালে ৩আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় লিপি বেগম ও ২০২৩ সালের ১৪মে আখিনুর নামের প্রসূতি নারীর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ উঠে।
এসব ক্লিনিকের মালিকরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। এছাড়াও এ ব্যবসার সাথে ক্ষমতাসীন দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা জড়িত রয়েছেন। যার কারণে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি মৃত্যুর পর থানায় অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কাউকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন ভাবে চাপ দিয়ে নিহতের পরিবারকে ম্যানেজ করা নেয় প্রভাবশালী মালিকরা। অপরদিকে এসব মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য বিভাগ দৃশ্যমান শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ঘটনার পরে ক্লিনিক সিলগালা করা হলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই পুনরায় ক্লিনিক চালু করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী এসব ক্লিনিক মালিকরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে উপজেলা ও জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে এসব ক্লিনিক ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।
নিহত রোগীদের স্বজনেরা জানান, সন্তান সম্ভবা নারীদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত নার্সসহ একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক ‘দ্রুত সিজার করতে হবে’ বলে ভয় দেখানো হয়। সরকারি হাসতাপালে সিজার না হওয়ায় দালালেরা প্রসূতিদের বেসরকারি ক্লিনিক গুলোতে নিয়ে যান। এসময় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ গ্রাম গঞ্জের সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। সেখানে ভূয়া ও অদক্ষ চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় ও অবহেলায় প্রায় ঘটছে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা। এরই মধ্যে অনেক প্রসূতিকে পঙ্গুত্বও বরণ করতে হয়েছে।
উপজেলার পূর্বকালাইয়া গ্রামের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলেন, ৮মাস আগে আমার সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। নরমালভাবে সন্তান প্রসবে জটিলতা দেখা দেয়। হাসপাতালে ডাক্তার না থাকায় বাহিরে ক্লিনিকে সিজার করি। যার ব্যয় বহন করতে আমার ধার দেনা করতে হয়েছে।
এবিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সাহা দেশ চ্যানেলকে বলেন,চিকিৎসক সংকটের কারণে অস্ত্রোপচর বন্ধ রয়েছে। এখানে কোনো চিকিৎসক আসতে চায় না। পদায়ন করা হলে মন্ত্রাণালয়ে তদবির করে অন্যত্র চলে যায়। ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক বার চাহিদা পাঠিয়েছি।
পটুয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন এস.এম কবির হাসান বলেন, শুধু বাউফল নয়, জেলার বিভিন্ন হসপাতালেই প্রসূতি অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। চিকিৎসক সংকট দূর করতে মন্ত্রাণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। পদায়ন হলে সমস্যার সমাধান হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ম্যানেজের প্রশ্নই আসে না। এসব অভিযোগ মিথ্যা।অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়গনিস্টিক গুলোতে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে।