জাহাঙ্গীর আলম, ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধিঃ
ড্রাগন চাষে ধ্বংস হচ্ছে ধান চাষের জমিসহ ফলজ ও বনজ বাগান। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলাসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক হারে ড্রাগন চাষের কারণে একের পর এক গিলে খাচ্ছে ধানি ও সবজি চাষের জমি। যে কারণে শীত কালের সবজিও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। জনসাধারণের আশংকা অনিয়নত্রিত ড্রাগন চাষ ভবিষ্যতে খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বাড়াবে। ড্রাগন ফলে ব্যাপক লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলের চাষীরা ড্রাগন চাষের দিকে বেশি ঝুকে পড়েছে। যার ফলে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে ধানী ও সবজি জমি বাড়ছে ড্রাগন চাষ। কোটচাঁদপুর উপজেলার নওদাগ্রাম, কাশিপুর, বলুহর, রামচন্দ্রপুর, লক্ষীকুন্ডু, বালিয়াডাঙ্গা, এলাংগী, সাবদারপুর, শ্রীরামপুর, ফুলবাড়িসহ সর্বত্র এখন ড্রাগন চাষের মহাউৎসব চলছে। এদিকে মহেশপুর উপজেলার গৌরীনাথপুর, আলামপুর, মালাধরপুর, বিদ্যাধরপুর, কুলবাগান, আজমপুর, আদমপুর গ্রাম গুলোতে ধানি ও অন্যান্য ফসলাদির জমি পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। এমনকি ফলজ ও কাঠ জাতীয় বাগান কেটেও ড্রাগন চাষ করা হচ্ছে। দেখাদেখি এ ড্রাগন চাষ পার্শ্ববর্তী উপজেলাতেও ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে । মহেশপুর উপজেলার গৌরীনাথপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, তিনি ও তার নিকটাত্মীয় জাহিদুল ইসলাম ৭/৮ বছর আগে প্রথমে ড্রাগনের চারা সংগ্রহ করে দুজনে দেড় বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করেন। এক বছরের মাথায় ওই দেড় বিঘা জমির ড্রাগন ফল বিক্রি করেন ১২ লাখ টাকায়। পরের বছর তারা আরও পাঁচ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করেন। তাদের ড্রাগন চাষে অল্প সময়ে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়া দেখে ওই এলাকাতে ড্রাগন চাষের প্রতিযোগীতা শুরু হয়। বর্তমানে নজরুল ইসলাম একাই চাষ করছেন ২০ বিঘা ড্রাগন । এ প্রতিবেদক সরেজমিনে কোটচাঁদপুর -মহেশপুর গ্রামের মাঠে গেলে দেখতে পান চারপাশে ড্রাগন আর ড্রাগন। পাশে দু’একটা ফাঁকা জায়গা থাকলেও সেখানেও চলছে ড্রাগন চাষের মহাউৎসব। চলছে অপরিপক্ক কাঠ জাতীয় গাছের বাগান, কমলা লেবু, মালটা, পেয়ারা, আম বাগান কাটার ধুম। এ সব বাগান থেকে চাহিদা অনুযায়ী ফল বা অর্থ না পাওয়ায় সেখানে তারা ড্রাগন চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ ছাড়া গত বছর যে জমিতে ধান চাষ ছিল এ বছর সে জমিতে ড্রাগন চাষ করা হয়েছে। গৌরিনাথপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের সাথে কথা হয় এখানে আর ধানি জমি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে এখন ধানি জমি খুব বেশি নাই। সব ধানি জমিতে এখন ড্রাগন চাষ হয়। পাশেই ড্রাগন ক্ষেতে কাজ করছিলেন আব্দুর জব্বার তিনি বলেন, দু’বছর আগেও এ মাঠে চাষ হত ধান, বাদাম, ভুট্টাসহ নানাবিধ ফসল। এখন সে ফসল আর নেই বললেই চলে। এখন নিচু জমি গুলোতে সামান্য কিছু ধান চাষ হচ্ছে আর বাকী সব জমিতে ড্রাগন। গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে বাড়ীর উঠানেও অনেকে ড্রাগন চাষ করেছেন। ওই গ্রামের বিল্লাল হোসেন বলেন, আমি ও আমার ভাইপো তরিকুল ইসলাম ৩৫বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করেছি। এসব জমিতে আগে ধান, বাদাম ভুট্টাসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ করা হত। এ সকল ফসলের আবাদে খরচ ঠিকমত ওঠে না। একবিঘা জমিতে ওই সকল ফসল চাষ করে বছরে পাওয়া যেত ১লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এর মধ্যে কৃষি শ্রমিক, সার, কীটনাষকসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিলে খুব একটা লাভ থাকে না। অথচ ১বিঘা ড্রাগনে বছরে ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা বিক্রি করা যায়। খরচ বাদ দিলে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা অনায়াসে লাভ থাকে। এলাকায় ব্যাপক ড্রাগন চাষ হওয়ায় ৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোটচাঁদপুর শহরে, মহেশপুরের গৌরনাথপুর ও আদমপুর নামক গ্রামে বড় বড় তিনটি ড্রাগন হাট চালু হয়েছে। ড্রাগনের মৌসুমে এই হাট তিনটি থেকে গড়ে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ কোটি টাকার ড্রাগন বিক্রি হয়। এখান থেকে পাইকারী ড্রাগন ব্যবসায়ীরা ড্রাগন ফল ক্রয় করে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
এ বিষয়ে মহেশপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব প্রাপ্ত) আসাদুজ্জামান বলেন, দিন দিন ধানি জমি আশংকা জনক ভাবে কমে যাচ্ছে কথাটা ঠিক। আমরাও চাষীদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। বলছি আপনার যদি ৫বিঘা জমি থাকে ৪বিঘাতে ধান চাষ করেন ১বিঘাতে ড্রাগন লাগান। তাতে চাষীরা কর্ণপাত করছেন না। তিনি আরও বলেন, চাষীরা বাণিজ্যিক ভাবে ড্রাগন চাষে লাভবান বেশী হচ্ছেন সে কারণে এ চাষেই ঝুকে পড়ছেন বেশী। এখানে বর্তমানে ৪শত হেক্টরের বেশী ড্রাগন চাষ হচ্ছে । প্রতিদিনই ড্রাগন চাষ বাড়ছে। কি পরিমান ধানি জমি কমে গেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে সবই প্রায় ধানি জমি। এর মধ্যেই সব ধরনের চাষ করে কৃৃষকরা। তবে আগামী ধান মৌসুমে জরিপ ছাড়া সঠিক তথ্য দেয়া সম্ভব নয়।
কোটচাঁদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজিবুল হাসান বলেন, কোটচাঁদপুরেও দিনে দিনে ড্রাগন চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে কোটচাঁদপুরে ৩শত হেক্টরের বেশী ড্রাগন চাষ হচ্ছে। আশংকার বিষয় হচ্ছে ধানি জমিসহ ফলজ ও বনজ সম্পদ ধ্বংস করে ড্রাগন চাষ করছেন চাষীরা। বাণিজ্যিক ভাবে ড্রাগন চাষে তারা লাভবান হচ্ছে বেশী। যে কারণে অন্যান্য চাষে আগ্রহ কম। তিনি বলেন যেহেতু ধানি জমি কমে যাচ্ছে সেহেতু ধানের লক্ষমাত্রা পূরণে আগামীতে ধান উৎপাদন অব্যাহত রাখতে আরও উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে চাষীদের উদ্ভুদ্ধ করতে হবে আমাদেরকে। তিনি আরও বলেন, ড্রাগনের মত এধরণের ফলের চাষ ব্যাপক হারে হলেও প্রাকৃতিক নিয়মে এক সময় চাষীরা ধানসহ পূর্বের অন্যান্য ফসল চাষে তারা আবারও ফিরে আসবে। তবে তিনি আগামীতে ধান চাষে লক্ষমাত্রা পূরণে খুব একটা সমস্যা হবেনা বলে জানান।
কোটচাঁদপুর কালিগঞ্জ মহেশপুর রেঞ্জের বন কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, চাষীদের যে ফসলে লাভ বেশী তারা সে দিকে ঝুকে পড়ে। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা অপরিপক্ক কাঠের গাছ না কাটার জন্য নানান ভাবে পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু তারা শুনছেননা। যে কারণে চাষীদের ফসলের জন্য গাছ কাটা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।