রুপম চাকমা বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রতিনিধি
রাঙ্গামাটি বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে বনানি বন বিহারে শুভ মধু পুর্ণিমা উদযাপন করেছে বনানি বন বিহার পরিচালনা কমিটি।
আজ ২৮ সেপ্তেম্বর ২০২৩ সকাল ৯ টায় অনুষ্টান পরিচালনা করেন বাবুধন চাকমা ও পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন রুপায়ন চাকমা সহকারি শিক্ষক বাঘাইহাট উচ্ছ বিদ্যালয়, স্বাগতিক বক্তব্য রাখেন বনানি বন বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি শাক্যবদি চাকমা।
অনুষ্টানে বুদ্ধমুর্তিদান, সংঘদান, অষ্টপুরস্কারদানও হাজার প্রদীপ দানসহ নানা যোগ্য আয়োজন করা হয়। অনুষ্টানে স্বধর্ম দেশনা প্রদান করেন বনানি বন বিহার অধ্যক্ষ কৃপা রত্ন স্হবির ভান্তে। কৃপারত্ন ভান্তে তার দেশনায় বলেন আজকের এই দিনটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এই দিনটি খুবই গুরুত্বপুর্ন দিন।
শ্রদ্ধেয় কৃপারত্ন ভান্তে মধু পূর্ণিমার তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন আমরা মধুপূর্ণিমা উদযাপন করে থাকি তা ব্যাখ্যা করা হলো।
মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে এক বিশেষ তাৎপর্যময় ঘটনা। এটি ভাদ্র মাসে উৎযাপিত হয় বলে এটিকে ভাদ্র পূর্ণিমাও বলা হয়। এ পূর্ণিমার বিশেষ দিক হল বানর এবং হস্তীরাজ কর্তৃক বুদ্ধকে সেবা ও পূজা করার ঘটনা। কেননা, ত্রিপিটকে পশু কর্তৃক বুদ্ধকে পূজা ও সেবা দান করার দৃষ্টান্ত খুব বেশী নয়। বানর এবং হস্তীরাজের এরকম বিরল দৃষ্টান্ত আমরা যাঁরা সুদুর্লভ মানব জীবন লাভ করেছি আমাদের অনুকরণীয় তথা শিক্ষণীয় উদাহরণ বৈ কি!
ভগবান তথাগত বুদ্ধ গৌতমের সময়ে বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ এলাহাবাদ হতে প্রায় ১২ মাইল উত্তর পশ্চিমে কৌশাম্বী নামে এক সু-সমৃদ্ধশালী নগরে তথাগত খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮০ অব্দে তাঁর জীবনের নবম বর্ষাবাস অতিবাহিত করেন। তখন সেখানে একটি বিহারে দুইজন ভিক্ষুর মধ্যে শৌচাগারে জল রাখা সম্পর্কিত বিনয় বিধান নিয়ে কলহ সৃষ্টি হয়।
মহামতি সম্যকসম্বুদ্ধ ভিক্ষুদের কলহ নিবারণার্থে ‘লটুকিকা’ জাতক, ‘বত্তক’ জাতক দেশনা করলেন, তাতেও ভিক্ষুদের কলহ নিবারিত না হলে রাজা দীঘীতির কাহিনী অর্থাৎ রাজা দীঘীতির উপদেশে কিভাবে রাজপুত্র দীর্ঘায়ু কুমার ও রাজা-রাজার স্ত্রীকে হত্যাকারী অপর রাজার মধ্যে মিত্রতা স্থাপন হয়েছিল সে বিষয় দেশনা করলেন। দেশনার পর মহামতি সম্বুদ্ধ কলহরত ভিক্ষুদের উপলক্ষ করে বললেন, “হে ভিক্ষুগণ, এরূপ অস্ত্রশস্ত্র ধারী রাজাদের যদি প্রচন্ড শত্রু“তা হতে মিলন হতে পারে তবে এমনতরো সু-আখ্যাত ধর্ম বিনয়ে প্রব্রজ্যিত হয়েও তোমরা কেন বিবাদ বিসম্বাদে লিপ্ত? তোমরা কলহ করোনা।”
বুদ্ধের কথায় কলহপ্রিয় এক ভিক্ষু যিনি উলিখিত জাতকদ্বয় বর্ণনাকালেও বুদ্ধকে এ বিষয়ে মাথা না ঘামাতে বলেছিলেন তিনি এবারও তদ্রুপ বললে “মোঘপুরুষগণ অত্যন্ত কলহরত হয়ে গেছে, এদের চৈতন্যোদয় সহজ নয়”, এ ভেবে বুদ্ধ সেখান হতে চলে গেলেন।
তদনন্তর তথাগত শাক্যসিংহ কৌশাম্বী থেকে বালক লোণকার গ্রাম এবং সেখান হতে প্রাচীন বংশদাব নামক স্থানে স্থবির অনুরুদ্ধ, স্থবির নন্দিয় এবং স্থবির কিম্বিলের সাথে সাক্ষাৎপূর্বক পারিল্যেয়ক নামক বনে প্রবেশ করলেন।
বর্ষাবাসের সময় ভগবান পারল্যেয় নামক সেই বনে বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করেছিলেন। যেটি ছিল বুদ্ধ জীবনের ১০ম বর্ষাবাস। সে সময় বুদ্ধ চিন্তা করলেন, “আমি পূর্বে সেই ভন্ডনকারী, কলহ লিপ্ত, বিবাদ-বিসম্বাদ প্রযুক্ত, বহুবৃথাবাক্য ব্যয়কারী ও নিত্য সংঘের নিকট অভিযোক্তা কৌশাম্বীবাসী ভিক্ষুগণ কর্তৃক উপদ্রুত হয়ে অনুকুলভাবে অবস্থান করতে পারি নি। এখন আমি তাদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে স্বচ্ছন্দে বিহার করতে সমর্থ হচ্ছি।”
সে সময় একটি বয়োবৃদ্ধ হস্তীরাজও অপরাপর হস্তী, হস্তীনী, তরুণ হস্তী ও হস্তীশাবক কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে, অপুুষ্টিকর ও অখাদ্য খেয়ে অবস্থান করছিল। অপরাপর হস্তীরা তার গাঁ ঘেষে গমন করত। হস্তীরাজ কর্তৃক যোগাড়কৃত শাখা,পত্র-পলব খেয়ে ফেলত, পানীয় জল ঘোলা করে দিত। হস্তীরাজও এরকম হস্তীদের উপদ্রব হতে বাঁচার নিমিত্তে একাকী চলে আসল। অনন্তর হস্তীরাজও চিন্তা করল, “পূর্বে আমি হস্তীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নিপীড়িত নিগৃহীত হতাম, আর এখন তাদের ত্যাগ করে এসে মনানন্দে নির্বিঘ্নে অবস্থান করতে পারছি।” ভগবান যে স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন সে স্থানটি কৌশাম্বী হতে সাত যোজন(এক যোজন = সাত মাইল দুরত্ব) দূরে এবং সেই বনটি ছিল তিন যোজন প্রমাণ। এই বনের রক্ষিতবনাঞ্চলে ভদ্রশাল বৃক্ষমূলে ভগবান অবস্থান করছিলেন। পারল্যেয় বনে অবস্থানের দরুণ বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে পারল্যেয় হস্তী নামে সমধিক পরিচিত সেই পূর্বোক্ত হস্তীরাজও বনমধ্যে বিচরণ সময় একাকী বুদ্ধকে দেখলেন। বুদ্ধকে দেখেই হস্তীরাজ স্বীয় নির্জনতার উপরোক্ত প্রীতিবাক্য বলেছিলেন। স্বয়ম্ভু শাক্যমুনি নিজের চিত্ত বিতর্ক এবং স্বচিত্তে হস্তীর চিত্ত বিতর্ক অবগত হয়ে উদানগাথা অর্থাৎ আনন্দ গাথা ভাষণ করলেন এভাবে
সম্বুদ্ধে মিলায় চিত্ত আপন জীবনে
যেহেতু উভয়ে রমে একা এই বনে।
হস্তী বুদ্ধের নিকট গিয়ে বুদ্ধকে বন্দনা করেছে। সেখানে অন্য কিছু দেখতে না পেয়ে ভদ্রশাল বৃক্ষের পাদদেশ পায়ের দ্বারা আঘাত করে সমান করে দিল। শুণ্ডের দ্বারা শাখা নিয়ে বৃক্ষতল পরিষ্কার করে দিল। এতদৃশ্য দর্শনে বুদ্ধ হস্তীকে বললেন, “হস্তীরাজ, তুমি একাকী অবস্থান করছ, আমিও একাকী অবস্থান করছি।” সে সময় হতে হস্তী ভগবানকে বিবিধ ভাবে সেবা পরিচর্য্যা করত। বুদ্ধ ভিক্ষান্ন সংগ্রহে যাবার সময় পাত্র নিয়ে আগু বাড়িয়ে দিত, আগমন কালেও আগু বাড়িয়ে নিয়ে আসত। বুদ্ধের মুখ ধোবার ও পান করার জল এনে দিত, বন হতে বিবিধ ফলমূল সংগ্রহ করে ভগবানকে দান দিত সশ্রদ্ধ চিত্তে। এভাবে বুদ্ধ এবং হস্তীরাজ যখন অবস্থান করছিল সে সময় এক বানর হস্তী কর্তৃক বুদ্ধ পূজা দর্শন করল।
বানর চিন্তা করল, “হস্তীও পশু আমিও পশু, হস্তী যদি বুদ্ধের সেবা করতে পারে, দান করতে পারে তবে আমি কেন পারব না? হস্তীর দান যেহেতু বুদ্ধ গ্রহণ করেন, অনুমোদন করেন, ভোজন করেন। আমার দানও নিশ্চয় মহাপুরুষ বুদ্ধ গ্রহণ করবেন, অনুমোদন করবেন, ভোজন করবেন।” তৎপর বানর বুদ্ধকে কি দান করবে তা ভেবে বনে বিচরণ পূর্বক কোন একদিন কোন এক বৃক্ষ দন্ডে মধু মক্ষিকা বিহীন এক মৌচাক দেখতে পেল।