বিপ্লব সরকারঃ সটাফ রিপোর্টার,নওগাঁ
তৃণমূলের সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বদলে যাচ্ছে একটি গ্রামের চিত্র। নওগাঁর পত্নীতলার পাটিআমলাই গ্রাম এখন আর দশটা সাধারণ গ্রামের মতো নয়; বরং এটি হয়ে উঠছে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর এক জনপদ। স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বেচ্ছাশ্রম, তরুণদের সৃজনশীল উদ্যোগ এবং দি হাঙ্গার প্রজেক্টের কারিগরি সহযোগিতায় গ্রামটি এখন টেকসই উন্নয়নের এক রোল মডেল।
সরেজমিনে পাটিআমলাই গ্রামে গিয়ে দেখা যায় এক উৎসবমুখর কর্মব্যস্ততা। নাহিদা সুলতানা নামের এক সচেতন গৃহবধূর নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবী গ্রামের রাস্তাঘাট পরিষ্কার করছেন। তাকে সহযোগিতা করছেন জেসমিন আক্তার, যিনি নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে গ্রাম উন্নয়নের এই মহতী মিশনে সামিল হয়েছেন। নাহিদা সুলতানা বলেন, “আমরা আমাদের গ্রামকে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি, যেখানে প্রতিটি মানুষ সচেতন থাকবে।”
পাটিআমলাই সরদারপাড়ার ১১৯টি পরিবারের চিত্র এখন আমূল পরিবর্তিত। এখানে প্রতিটি পরিবার এখন নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। গত তিন বছরে জন্ম নেওয়া ১৪টি শিশুর মধ্যে ১১টিই সরকারি হাসপাতালে নিরাপদ ডেলিভারির মাধ্যমে হয়েছে। শতভাগ শিশুর টিকা ও জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিত করা হয়েছে।
দি হাঙ্গার প্রজেক্টের প্রশিক্ষিত নারী নেত্রী জেসমিন আক্তার গ্রামে ‘পুষ্টি উজ্জীবক’ হিসেবে কাজ করছেন। তিনি গর্ভবতী মা ও শিশুদের পুষ্টিমান পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্ট (মাতৃকণা ও পুষ্টিকণা) বিতরণ করেন। গ্রামবাসীর কাছে তিনি এখন ভরসার এক নাম, যাকে সবাই ‘গ্রামের ডাক্তার’ বলে সম্বোধন করেন।
গ্রামটিতে কোনো বাল্যবিবাহ নেই। প্রতিটি শিশু নিয়মিত বিদ্যালয়ে যায়। মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করান জন্য গ্রামের তরুণরা গড়ে তুলেছে ‘ইয়ূথ ইউনিট’ ও ‘পাঠশালা’। নিয়মিত পাঠচক্র ও সৃজনশীল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তারা মেধা বিকাশে সচেষ্ট। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও গ্রাম উন্নয়ন দলের সভাপতি আলহাজ্ব আজিজুল ইসলাম নিজের অভিজ্ঞতায় গ্রামের সবাইকে স্বেচ্ছাব্রতি আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা একটি পরিচ্ছন্ন ও বিবাদমুক্ত গ্রাম গড়তে চেয়েছি, যেখানে সম্প্রীতি হবে মূল ভিত্তি।”
নিজেদের প্রয়োজনে গঠন করা হয়েছে ‘গণগবেষণা সমিতি’, যেখানে নারীদের সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। ফলে গ্রামের মানুষ এখন চড়া সুদের ঋণের হাত থেকে মুক্ত। প্রতিটি বাড়িতে এখন হাঁস-মুরগি ও গরুর খামারের পাশাপাশি বিষমুক্ত সবজি চাষের মাচা দেখা যায়। স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তা সিয়াম জানান, দি হাঙ্গার প্রজেক্টের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত ‘বীজ ব্যাংক’ থেকে প্রতিটি পরিবারকে বিভিন্ন শাক-সবজির বীজ ও চারা দেওয়া হয়েছে, যা তাদের স্থায়ী পুষ্টির চাহিদা মেটাচ্ছে।
গ্রামবাসীদের এই উদ্যোগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে পাটিচরা ইউনিয়ন পরিষদ। চেয়ারম্যান সবেদুল ইসলাম রনি ইতিমধ্যে গ্রামের কর্দমাক্ত রাস্তা হেরিংবোন বন্ড (HBB) করে দিয়েছেন এবং ড্রেনেজ ও মসজিদের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন।
দি হাঙ্গার প্রজেক্টের এলাকা সমন্বয়কারী আসির উদ্দীন জানান, পত্নীতলায় মোট ১১০টি গ্রামকে এভাবে গড়ে তোলার কাজ চলছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে পাটিআমলাইসহ প্রায় ৫০টি গ্রামকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পুষ্টিসমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর গ্রাম’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে।
তৃণমূলের এই জাগরণ প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষের সদিচ্ছা ও সামান্য সহযোগিতা থাকলে একটি গ্রাম তথা গোটা দেশই টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে।

