মোঃআতিকুর রহমান আজাদ;
মাদারীপুর প্রতিনিধিঃ
মাদারীপুরের ডাসারের অবহেলিত এক জনপদের নাম চলবল খাঁ। সোজাসুজি উত্তর ও দক্ষিন দিকে
লম্বা একই জনপদের দুটি গ্রাম। একটি গ্রামের নাম দক্ষিণ চলবল খাঁ অপরটির নাম উত্তর চলবল খাঁ। দু‘বছর আগে মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলা থেকে ৫ ইউনিয়ন কেটে নিয়ে গঠন করা হয় ডাসার উপজেলা। এই নবগঠিত ডাসার উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের একটি হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলের নাম চলবল খাঁ। গ্রামটি নিচু হওয়ায় বছরের প্রায় ছয়-সাত মাসই জলমগ্ন থাকে। প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই গ্রামে পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস। এই অঞ্চলে প্রায় দেড়‘শ বছর আগে থেকে জনবসতি গড়ে উঠলেও আজ পর্যন্ত এই অভাবনীয় উন্নয়নের যুগে পাকা সড়ক দূরের কথা, কোনো কাঁচা রাস্তা নেই। গ্রামের মানুষ শুষ্ক মৌসুমে জমির আইল পথ দিয়ে চলাচল করতে পারলেও বর্ষা মৌসুমে চলাচলের জন্য একমাত্র ডিঙি নৌকাই ভরসা তাদের। ফলে দীর্ঘদিন ধরে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছেতাদের। পাকা বা কাঁচা সড়ক না থাকায় বছরে বার মাসই এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া যাতায়াতে বাঁশের সাঁকোই একমাত্র ভরসা। গ্রামের বাসিন্দারা জানায়, জনসাধারণের উদ্যোগে ১৯৮৬ সালে উত্তর চলবল উচ্ বিদ্যালয় এবং ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ চলবল উ”চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই দুই বিদ্যালয়ের সঙ্গেই রয়েছে দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই চারটি বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে সহশ্রাধিক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া গ্রামটিতে রয়েছে ছয়টি মন্দির ও একটি আশ্রম। আশ্রমে অনেক ভক্তের আগমন ঘটে। কিন্তুএ অঞ্চলে যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই, বর্ষায় ডিঙি নৌকা, আর শুষ্ক মৌসুমে কর্দমাক্ত ক্ষেতের আঁইল পথই যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। গ্রামটি বিল অঞ্চল হওয়ায় ডিজিটাল যুগেও উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এছাড়া বৃদ্ধ ও শিশুরা থাকেন আতঙ্কে। কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে,কে কখন বিনা চিকিৎসায় মারা যায়! উন্নত স্বাস্থ্যসেবা তো দূরের কথা,ন্যুনতম স্বাস্থ্যসেবাও এখানে অনুপস্থিত
সরেজমিন গ্রামটি ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামের দু‘টি স্কুলের পাশে ছোট্ট দুটি বাজার গড়ে উঠেছে। তবে নেই কোনো স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা এমনকি একটি ফার্মেসিও চোখে পড়েনি। গ্রামবাসী জানায়, কেউ অসুস্থ হলে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায়ই মারা যায়। গুরুত¦ পুর্ন কোন রোগীকে হাসপাতালে
নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে নিতে গেলেও পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে নিতে হয় ডিঙি নৌকায় করে। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও ঝুঁকি নিয়ে ডিঙি নৌকায় করে চলাচল করতে হয়। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। বর্ষা মৌসুমে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা দিয়ে সরুখাল ও বিল পার হতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকেই পানিতে পড়ে যায়। তখন তাদের জামা-কাপড়, বই-খাতা ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও বছরের অন্য সময় জমির আইল দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। বৃষ্টিতে এসব আইল পথ প্লাবিত হলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় সকলের। তাদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘবে আজ পর্যন্ত কোনো জনপ্রতিনিধি পদক্ষেপ নেননি। নির্বাচনের আগে অনেকে নানা প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু নির্বাচনের পর কেউ গ্রামবাসীর খবর নেন না। আধুনিক যুগেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি অবহেলিত জনপদে। প্রত্যন্ত এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বিপর্যয় দীর্ঘকালের। কয়েকযুগ পেরিয়ে গেলেও এলাকাবাসীদের ভাগ্যে জুটেনি একটি সেতু, রাস্তা, কালভার্ড। বাঁশের সাকো দিয়েই পারাপার হচ্ছে কয়েক হাজার পরিবার। কয়েক দফায় সেতুর জন্য মাটি পরীক্ষা করা হলেও হয়নি সেতু।
এলাকাবাসী জানান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এই দুর্গম এলাকার উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে ছিলেন। নবগ্রাম সড়ক থেকে উত্তর ও দক্ষিন চলবলের মধ্য দিয়ে একটি দুই লেনের সড়ক নির্মাণের সমীক্ষা করা হয়। পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিন চলবল বড় দু‘টি খালের ওপর দুইটি বড় সেতু নির্মাণ করতে টাকা বরাদ্দ করেন। সড়কের সমীক্ষার পাশাপাশি ব্রিজের কাজ শুরু হয়। ব্রিজের পিলারের কাজ হলেও ঢালাই বাকী থাকে। সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় এই প্রকল্প। আর বরাদ্দের টাকা কেটে অন্যত্র নেওয়া হয়। বর্তমানে নির্মাণাধীন সেতুর পিলারগুলো অকোজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেছে সড়কের সমীক্ষার কাজ। ফলে এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ আর লাঘব হয়নি। এলাকাবাসীরা জানান, জনপ্রতিনিধিদের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি শুধু নির্বাচন কেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ। নির্বাচন আসলে তখন উন্নয়নের বুলির আড়ালে নির্বাচিত হয়ে গেলে তখন আর দেখা মেলা ভার সেই সব জনপ্রতিনিধিদের। ভোটের সময় পূর্নিমার চাঁদের মতো উদিত হয়ে ভোটের পর আমাবশ্যার চাঁদের মতো হারিয়ে যায় তারা। উন্নয়ন যা হয়,তা আবার নিজ বসবাসকৃত এলাকা কেন্দ্রীক। ফলে, ভাগ্যের বদল হয় না অন্যসব ইউনিয়নের বসবাসকৃত ভুক্তভোগী জনসাধারণের। ¯স্থানীয় বাসিন্দা সুভাষ মল্লিক বলেন, ‘আমার বয়স ৭০ পেরিয়ে যাচ্ছে এই বয়সেও বাঁশের সাকো দিয়ে পারাপার হতে ভয় লাগে কখন কি হয়? কয়েক দফায় মাটি পরীক্ষা করে যায় সেতুর মুখ দেখা যায়নি এখনো।
এলাকার তাপস মন্ডল জানান, দীর্ঘ ৩৫বছর ধরে এমনই অবস্থা চলাচল অনুপোযোগী রাস্তাঘাট। কোন যানবাহন নেই। পায়ে হেটে চলাচল করতে খুব কষ্ট হচ্ছে কেউ অসুস্থ হলে জরুরী মূহুর্তে এম্বুলেন্স তো দুওে কথা একটি ভ্যান গাড়ি যে আসবে সে রকম সড়কও নেই। আমাদের এই
ভোগান্তি দেখার আছে কে?
রতন বালা নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘প্রতিনিয়ত কয়েক হাজার মানুষের চলাচলের ভরসা এই বাঁশের সাকো। ছেলে-মেয়েরা স্কুল কলেজে যায় এটি পার হয়ে। সাকোর বাঁশ পুরনো হয়ে গেলে পারাপারের সময় আচমকা ভেংগে পরে যেতে হয় । কয়েক জনের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে।’ দক্ষিন চলবলখাঁ গ্রামের নিকোলাস হাওলাদার বলেন, ‘আমাগো দক্ষিন চলবলখাঁ গ্রামে রাস্তা-ঘাটের কোন উন্নতি নাই। আমাগো অনেক দূর থাইক্যা হাইট্যা আসতে হয়। সরকার যদি রাস্তা কইরা দিতো, তাইলে আমাগো অনেক উপকার হইতো। ভোটের সময় হইলে আমাগো কদর বাড়ে। আমাগো দাবী পূরণের কথাও বলে। কিন্তু ভোটের পরে তাগো আর দেখা পাওয়া যায় না।’
নবগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদকও সাবেক চেয়ারম্যান বাবু বিভূতি ভূষন বাড়ৈ বলেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যা যাতায়াত ব্যবস্থা। স্বাধীনতার পর থেকে ৫২বছরেও কোন ধরণের উন্নয়ন হয়নি। এখানে দুটো হাই স্কুল ও দুটো প্রাইমারি স্কুল ছাড়া আর কিছুই নাই। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা করুণ। চলবল খাঁ একটাই মৌজায় দুটি গ্রাম। মৌজাটির দৈর্ঘ ৭ কিমি আর প্রায় প্রায় ৪ কিমি। শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে সাকো আর ডিঙি নৌকাই ভরসা। এই দুই গ্রামের কোথাও পাকা রাস্তা তো দূরের কথা, পায়ে হাটা কাচা রাস্তাটিও সেই ভাবে নেই। আমাদের এই কষ্টের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আজ পর্যন্ত কেই বা কোন জনপ্রতিনিধি এই এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারে কোন উদ্দ্যোগ নেয়নি। কেউ দেখতেও আসেনি আমরা কেমন আছি। উত্তর চলবল এলাকার লোকজন বের হয় কোটালীপাড়া পিড়ারবাড়ি দিয়ে আর দক্ষিণ চলবল গ্রামের লোকজন বের হয় বাকাল বাহাদুরপুর দিয়ে। নবগ্রাম স্কুল থেকে যদি পশ্চিম দিকে একটা রাস্তা যায় আর ওই রাস্তাটা যদি দক্ষিন চলবচল দিকে যায় তাহলেই মোটামুটি আমাদের যাতায়াতে কিছুটা উন্নতি হয়। মোটামুটি ১২কিমি রাস্তা হলে আমরা যাতায়াত করতে পারি। আমরা সারা বছর নৌকা বেয়ে স্কুল কলেজে লেখাপড়া করেছি। আমাদের এলাকায় শিক্ষার হার অত্যান্ত ভালো। অথচ আমরাই আজ সবচেয়ে অবহেলার শিকার।
অত্র এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবক মিহির কুমার হাওলাদার বলেন,সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সংসদে থাকা অবস্থায় এই এলাকায় কিছু উন্নয়ন হয়েছে। পরবর্তিতে একটি রাস্তা ও দুটি ব্রিজের বরাদ্দ হয়েছিলো। ব্রিজের পিলারও হয়েছে, শুধু ব্রিজের ঢালাই বাকী ছিলো। আবুল হোসেন চলে যাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায় এবং বরাদ্দ টাকা কেটে অন্যত্র নিয়ে যায়। বিশেষ করে নবগ্রাম থেকে উত্তর চলবল ও দক্ষিন চলবলের সাধারন মানুষের কষ্টের সীমা নেই। আমরা এখন এমন অবস্থায় আছি এলাকার কেউ মারা গেলে লাশ কাঁধে করে বয়ে নিতে হয়।
এলজিইডির ডাসার উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ রেজাউল করিম বলেন, ‘পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক প্রকল্পে এই গ্রামের সড়কটি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ডিও লেটার পাঠাব। সেই সঙ্গে তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব।’
ডাসার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ আফরোজ বলেন, ‘আমি এখানে নতুন আসছি। চলবলখাঁ মৌজার বাসিন্দাদের দুর্ভোগের কথা আমি শুনছি। আমি খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টা দেখবো।’