মুফতি খোন্দকার আমিনুল ইসলাম আবদুল্লাহ ।
তারাবির নামাজের নিয়ম, রাকাত, নিয়ত, দোয়া ও মোনাজাত ।।
বছর ঘুরে মানবতার সুমহান আদর্শ নিয়ে বিশ্ব মুসলিমের দরবারে হাজির পবিত্র কুরআন ঘোষিত শ্রেষ্ঠ মাস পবিত্র মাহে রমজান। রমজান মাসে ইবাদত-বন্দেগির গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের ওপর একটি মর্যাদাপূর্ণ মাস ছায়া বিস্তার করেছে। এ পবিত্র মাসের একটি রাত বরকত ও ফজিলতের দিক থেকে হাজার মাস থেকেও উত্তম। এ মাসের রোজাকে আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন এবং এর রাতগুলোয় আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়ানোকে নফল ইবাদত রূপে নির্দিষ্ট করেছেন। যে ব্যক্তি রমজানের রাতে ফরজ ইবাদত ছাড়া সুন্নত বা নফল ইবাদত করবে, তাকে এর বিনিময়ে অন্যান্য সময়ের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব প্রদান করা হবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো ফরজ আদায় করবে, সে অন্যান্য সময়ের ৭০টি ফরজ ইবাদতের সমান পুণ্য লাভ করবে।’ (বায়হাকি)
রমজান মাসের নির্দিষ্ট নামাজ হচ্ছে সালাতুত তারাবিহ। তারাবির নামাজ হলো রোজার গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে তারাবি নামাজ পড়েছেন এবং সাহাবায়ে কিরামকেও পড়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তারাবি নামাজ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা বেশি সওয়াবের কাজ। এ নামাজে কোরআন শরিফ খতম করা অধিক সওয়াবের কাজ। তবে সূরা-কিরাআতের মাধ্যমে আদায় করলেও তারাবির সওয়াব পাওয়া যায়। কোরআন মজিদ যে ৫৪০ রুকুতে বিন্যাসিত হয়েছে তা তারাবির নামাজে প্রতিদিন ২০ রাকাতে ২০ রুকু করে পড়লে ২৭ রমজান লাইলাতুল কদরে পবিত্র কোরআনের সম্পূর্ণটুকু যাতে তিলাওয়াত করা সমাপ্ত হয়, সেদিকে ইমাম সাহেবদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার।
তারাবির নামাজ কি?
রমজান মাসের রাতে এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নতের পর এবং বিতর নামাজের আগে দুই দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, একে ‘তারাবি নামাজ’ বলা হয়। আরবি ‘তারাবিহ’ শব্দটির মূল ধাতু ‘রাহাতুন’ অর্থ আরাম বা বিশ্রাম করা। শরিয়তের পরিভাষায় মাহে রমজানে তারাবি নামাজ পড়াকালীন প্রতি দুই রাকাত অথবা চার রাকাত পরপর বিশ্রাম করার জন্য একটু বসার নামই ‘তারাবি’।
তারাবি নামাজের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রমজানের রাতে তারাবি নামাজ আদায় করেন, তাঁর অতীতকৃত পাপগুলো ক্ষমা করা হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে সওয়াব প্রাপ্তির আশায় রোজা রাখেন, তারাবি নামাজ পড়েন এবং কদরের রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করেন, তাঁর জীবনের আগের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
তারাবি নামাজের নিয়ত
উচ্চারণ: নাওয়াইতুআন উসালিয়া লিল্লাহি তাআ’লা, রাকাআ’তাই সালাতিত তারাবিহ সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তাআ’লা (*) মুতাওয়াযজ্জিহান ইলা যিহাতিল কা’বাতিশ শারিফাতি, আল্লাহু আকবার। ( * যদি জামাআ’তের সহিত নামাজ হয় তবে- ইক্বতাদাইতু বি হাজাল ইমাম বলতে হবে। )
অর্থ: আমি কিবলামুখী হয়ে (*) দুই রাকাআ’ত তারাবিহ সুন্নাত নামাজ আল্লাহর জন্য আদায়ের নিয়্যত করছি, আল্লাহু আকবার। ( * যদি জামাআ’তের সহিত হয় তবে- এই ইমামের ইমামতিতে জামাআ’তের সহিত। )
– যাদের আরবী উচ্ছারণ করতে সমস্যা হয় অথবা পড়তে পারেন না, তারা বাংলায় নিয়ত করতে পারবেন।
তারাবি নামাজের চার রাকাত পরপর দোয়া
উচ্চারণ: সুব্হানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুব্হানাযিল ইয্যাতি, ওয়াল আয্মাতি, ওয়াল হাইবাতি, ওয়াল কুদরাতি, ওয়াল কিবরিয়াই, ওয়াল যাবারুত। সুব্হানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা-ইয়াানামু ওয়ালা ইয়ামুতু আবাদান আবাদা। সুব্বুহুন কুদ্দুছুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালাইকাতি ওয়ার রূহ।
– প্রত্যেক দুই রাকাআ’ত পর সালাম ফিরানোর পর ইসতেগফার পড়তে হয়, দুরুদ পড়তে হয়, আল্লাহর স্মরণে জিকির করতে হয়। তারপর চার রাকাআ’ত হলেও কুরআন হাদিসের দুআ’গুলো পড়া হয়; যে দুআ’গুলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে পড়া হয়। কিন্তু তারাবির যে দুআ’টি বর্তমানে জারি আছে, এই দুআ’টি কোরআন-হাদিস সম্বলিত নয়; এটিও কোনো এক বুজুর্গ ব্যক্তি লিখে এর প্রচলন করেছেন, যার অর্থও ভালো বিধায় আমরা পড়ে থাকি।
তারাবিহ নামাজের চার রাকাত পরপর মোনাজাত
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা জান্নাতা ওয়া নাউ’জুবিকা মিনান্নারী, ইয়া খালিকাল জান্নাতা ওয়ান্নারী, বিরহতিকা ইয়া আজিজু, ইয়া গাফ্ফারু, ইয়া কারীমু, ইয়া সাত্তারু, ইয়া রাহীমু, ইয়া জাব্বারু, ইয়া খালিকু, ইয়া বার্র। আল্লাহুম্মা আযিরনা মিনান্নার; ইয়া মুযিরু, ইয়া মুযিরু, ইয়া মুযির। বিরহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহিমিন।
– চার রাকাআ’ত পর পর মোনাজাত করা যায়, আবার একেবারে নামাজ শেষ করেও একবারেই মোনাজাত করা যায়। তারাবিহ নামাজের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দুআ নেই। আমরা সব সময় নামাজের ক্ষেত্রে যে সব দুআ পড়ে থাকি এগুলো পড়লেই হয়। তারপরও বহু পূর্বে কোনো বুজুর্গ বর্তমানে তারাবিহতে পঠিত দুআ’র প্রচলন করেছেন; যার অর্থ ভাল এবং উত্তম বিধায় আমরা তারাবিহ নামাজে এই দুআটি পড়ে থাকি।
একনজরে
– এশার চার রাকাত সুন্নত।
– এশার চার রাকাত ফরজ।
– এশার দুই রাকাত সুন্নাত।
* দুই রাকআত দুই রাকআত করে তারাবির সালাত।
– এশার তিন রাকাত বেতের।
তারাবির নামাজ বিষয়ক প্রশ্ন-উত্তর
প্রশ্ন: তারাবির নামাজ কত রাকাত?
উত্তর: তারাবির সালাত দুই রাকআত দুই রাকআত করে যেকোনো সংখ্যক রাকআত পড়া হয়। তারাবির নামাজের রাকআত নির্দিষ্ট করা হয়নি। হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি ফিকহের অনুসারীগণ ২০ রাকআত, মালিকি ফিকহের অনুসারীগণ ৩৬ রাকআত এবং আহলে হাদীসরা ৮ রাকআত তারাবির পড়েন।
প্রশ্ন: তারাবির নামাজ কি সুন্নত না নফল?
উত্তর: তারাবির নামায নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
প্রশ্ন: খতম তারাবীহ এবং সূরা তারাবীহ কি?
উত্তর: বাংলাদেশে তারাবীহর নামাজের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত। একটি খতম তারাবীহ আর অন্যটি সূরা তারাবীহ। খতম তারাবীহর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কুরআন পাঠ করা হয়। খতম তারাবীহর জন্য কুরআনের হাফিযগণ ইমামতি করেন। সূরা তারাবীহর জন্য যেকোন সূরা বা আয়াত পাঠের মাধ্যমে সূরা তারাবীহ আদায় করা হয়।
যারা কুরআন খতম দিচ্ছেন, তাদের জন্য কিছু জরুরি পরামর্শ (এগুলো জানা উচিত)
(১) বেশি খতমের আকাঙ্ক্ষায় এমনভাবে তিলাওয়াত করবেন না যে, পড়া সহিহ হয় না। এতে তেমন ফায়দা হবে না। যেটুকু পড়বেন, ধীরে-সুস্থে, আগ্রহ সহকারে, ভালোবাসা নিয়ে পড়বেন। পরিমাণ কম হলেও আল্লাহ্ এতে বেশি খুশি হবেন।
(২) রামাদানের ২৭ তারিখ বা লাইলাতুল কদরের মধ্যেই খতম শেষ করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। (২৭ তারিখকে লাইলাতুল কদরের জন্য নির্দিষ্ট করাও ঠিক নয়)
(৩) কুরআন খতম করার পর কোনো ইমাম বা আলিমকে দিয়ে ‘বকশে দিতে হবে’ এমন চিন্তা-ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। নিজের তিলাওয়াত ও উদ্দেশ্যই যথেষ্ট। নিজে তিলাওয়াত শেষে নিজেই দু‘আ করতে পারেন।
(৪) চেষ্টা করবেন, রাতে কিছু সময় তিলাওয়াত করতে। কারণ রাতের তিলাওয়াত আল্লাহ পছন্দ করেন। এটা পূর্ববর্তী নেককারদের রীতি।
(৫) অর্থ বুঝে তিলাওয়াতের মর্যাদা অনেক বেশি। তবে, স্বাভাবিক তিলাওয়াতেও নেকি হয়। হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না। সাধারণভাবে খতমের পাশাপাশি প্রতিদিন কিছুটা সময় হলেও অনুবাদ অথবা তাফসিরসহ পড়ার চেষ্টা করবেন। এটা কুরআনের দাবি।
(৬) অধিকাংশ সালাফ এবং ইমামের মতে, মৃত ব্যক্তির মাগফিরাত বা নেকির উদ্দেশ্যে জীবিত ব্যক্তি কুরআন খতম দিতে পারবে। তাই, নিজের মৃত কোনো আত্মীয়ের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে কুরআন খতম দেওয়া যাবে। তবে, উত্তম হলো: মৃতদের জন্য বেশি করে দু‘আ ও দান সাদাকাহ্ করা। এ ব্যাপারে আলেমদের কোনো মতভেদ নেই।
(৭) এত জোরে তিলাওয়াত করবেন না, যাতে অন্যের ইবাদতে (যেমন: নামাজ, যিকর, দু‘আ) ব্যঘাত ঘটে। কারো সামনে তিলাওয়াত করা হলে তা শুনা তার জন্য ওয়াজিব। সুতরাং, কাউকে এই ওয়াজিব পালনে বাধ্য করবেন না। যতটুকু সম্ভব ধীরে পড়বেন। তবে, কেউ আগ্রহী শ্রোতা হলে জোরেই পড়ুন।
(৮) কুরআনে মোট ১৪ টি সিজদার আয়াত আছে। সেগুলো পাঠ করা মাত্রই সিজদা দিন। কোনো প্রয়োজন ব্যতীত এসব সিজদা বিলম্বে আদায় করা উচিত নয়।
(৯) কুরআন খতমের পর বিশেষ কোনো দু‘আ সহিহ কোনো হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত নয়। (শাতিবি রহ.-এর সূত্রে আলবানি রহ.)। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে শেষ করে দু‘আ করে নেবেন। দু‘আ করে আল্লাহকে তিলাওয়াতের সওয়াবের উদ্দেশ্য বলতে হবে, এমনটা জরুরি নয়। আল্লাহ্ জানেন, আপনি কী উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করছেন।
(১০) মুসহাফ তথা কুরআনের কাগজের কপি ধরতে অজু জরুরি। তবে, মোবাইলে পড়তে অজু জরুরি নয়। এই মত দিয়েছেন দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক প্রধান মুহাদ্দিস আল্লামা সাঈদ আহমাদ পালনপুরী (রহ.) আরবের ওলামায়ে কিরামসহ অনেকে। তবে, অবশ্যই অজু করে পড়াই উচিত। যারা অজু ছাড়া মোবাইলেও পড়া নাজায়েয বলেছেন, তারা এটুকু অনুমতি দিয়েছেন যে, মোবাইলে পড়ার সময় সরাসরি আয়াতে টাচ না করে স্ক্রিনের সাইডে টাচ করে পড়া যাবে। এটি একটি নিরাপদ মত।
সর্বাবস্থায় কুরআনের সাথে লেগে থাকা দরকার। হাদিসের ভাষায় আল্লাহ তা‘আল কুরআনকে যেন আমাদের ‘হৃদয়ের বসন্ত’ বানান। আমিন।
রামাদানের প্রস্তুতির ধাপসমূহ:
১. সত্যিকার তওবা করা আল্লাহর কাছে খাঁটি অন্তরে তওবা করা।
২. দোয়া করা – রামাদানকে ভালোভাবে পালন করার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাওয়া।
৩. রামাদানের আগমনে আনন্দিত হওয়া এই বরকতময় মাসকে পাওয়ার জন্য হৃদয়ে আনন্দ অনুভব করা।
৪. কাজা রোজা থাকলে তা রামাদানের আগে আদায় করা।
৫. সিয়ামের বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা রোজার সঠিক নিয়ম ও মাসআলা-মাসায়েল শেখা।
৬. রামাদানে ইবাদতে মনোযোগী হওয়ার জন্য অপ্রয়োজনীয় কাজ রামাদানের আগে শেষ করা যেন কোনো কাজ ইবাদতের অন্তরায় না হয়। (যেমন আলমারি গোছানো, মাসের বাজার ইত্যাদি।)
৭. পরিবারের সদস্যদের রোজার বিধান সম্পর্কে জানানো রোজার শারঈ বিধান ও করণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা।
৮. উপকারী বই প্রস্তুত রাখা রামাদানে পড়ার জন্য কিছু ইসলামিক বই সংগ্রহ করা।
৯. শাবান মাসে কিছু রোজা রাখা। রামাদানের জন্য নিজেকে অভ্যস্ত করা।
১০. কুরআন তিলাওয়াত করা রামাদানের প্রস্তুতি হিসেবে বেশি বেশি কুরআন পড়া।
মহান আল্লাহ্ আমাদের সকলকে কুরআন ও সুন্নাত মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দান করুন ।