নড়াইল জেলা প্রতিনিধি
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার পূর্বঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত সর্বনাশা মধুমতী নদীর ভাঙ্গনে কোটাকোল ইউনিয়নের তিন গ্রামের প্রবেশের রাস্তা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামে প্রবেশের রাস্তা না থাকায় ওই এলাকার কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষের জীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ ও দূর্দশা। তিনটি গ্রামে প্রবেশের রাস্তা না থাকায় স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা
সরজমিনে যেতে পারছেন না। ফলে দিনদিন দুর্ভোগের মাত্রা বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন নতুন রাস্তা নির্মানের দাবি নিয়ে নদী পাড়ে বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানববন্ধন সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করেও সৃষ্ট সমস্যার কোন সমাধান হয়নি।
খোজখবর নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই সর্বগ্রাসী মধুমতী নদী তার রুদ্ররূপ ধারণ করে। মধুমতী নদী ভাঙ্গনের করাল গ্রাসে উপজেলার কোটাকোল ইউনিয়নের রায়পাশা, করগাতি ও তেলকাড়া গ্রামে প্রবেশের প্রায় ৪ কিলোমিটার মূল কাঁচা রাস্তা নদী ভাঙ্গনে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে করে ওই তিনটি গ্রামে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষের চলাচলের রাস্তা না থাকায় তাদের জীবনে নেমে এসেছে অশেষ দুর্ভোগ। গ্রামে প্রবেশের রাস্তা না থাকায় সাধারণ মানুষের যেমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তেমনি ওই এলাকার স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। রাস্তা না থাকায় সব থেকে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। ওই তিন গ্রামের অসুস্থ রোগীরা রাস্তা না থাকায় কোনভাবেই এম্বুলেন্সসহ ইঞ্জিন চালিত কোন যানবাহন প্রবেশ করতে পারে না।।
আরও জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি, ভিটেমাটি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ সহায় সম্পদ। এমনকি বারবার ভাঙনে ওই এলাকার পাঁকা রাস্তাসহ বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের খুঁটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকাটি নদী ভাঙ্গন এলাকা বলে পরিচিত। এই তিনটি গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা মধুমতী নদী। বর্ষা মৌসুম এলে মধুমতী নদী তার যৌবন ফিরে পেলে নদী ভাঙ্গন শুরু হয়। প্রবল শ্রোতের কারণে শতশত বসতবাড়িসহ এলাকার হাজার হাজার একর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
এলাকাবাসী সূত্রে আরও জানা যায় অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তলনের কারণে এ ভাঙ্গন আরও তীব্রতর হয়ে উঠে। সূত্রে আরও জানা গেছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যে এলাকায় ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলনের কথা থাকলেও বালু খেকোরা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইজারাকৃত এলাকা থেকে বসতি এলাকায় এসে তারা বালু উত্তলন করে। তখন ভুকম্পনের সৃষ্টি হয়ে নদীর পাড় ভেঙে যায়।
তেলকাড়া গ্রামের মো. রেজাউল শেখের ছেলে ভ্যান চালক ফারুক শেখ, করগাতি গ্রামের ওহাব খানের ছেলে নাসির খান, রায়পাশা গ্রামের হাসেম খানের ছেলে মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. মোশাররফ হোসেন, তেলকাড়া গ্রামের পটু মিয়ার ছেলে কৃষক দিদার মিয়া ও করগাতি গ্রামে ভিটেমাটি হারা হেমায়েত হোসেনের স্ত্রী পাচি বেগমসহ অনেকে বলেন, অবৈধ ভাবে নদী থেকে বালু উত্তলন ও মধুমতী নদী ভাঙ্গনের ফলে আমাদের ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। আমাদের মাথা গোজার আর কোন ঠাই নাই। এমনকি এখান থেকে উপজেলা এবং জেলা শহরে যাতায়াতের কোন রাস্তা নেই। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে পায়ে হেটে চলাচল করতে হয়। আমাদের কোন স্বজন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য কোন যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই। ফলে সেই অসুস্থ ব্যক্তিদেরকে কাধে অথবা কোলে করে প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেটে যেতে হয়।
ভাঙন কবলিত এলাকার লোকজন আরও জানান, বিগত দিনে নদী ভাঙ্গনে রোধের জন্য সরকারের নিকট আবেদন করেও কোন ধরনের ফল হয়নি। যখন নদী ভাঙ্গন শুরু হয় তখন ভাঙ্গন রোধে কিছু বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পরে তা আবার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এযাবৎকাল সরকারের পক্ষ থেকে শুধু আশ্বাসের বানী শুনে আসছি আমরা। নদী ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী কোন সমাধান পায় না। আমরা এই তিন গ্রামে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ যেন সরকারের কাছে গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছি।
সরকারের কাছে ভাঙন কবলিত এলাকার জণগণের একটাই চাওয়া ও দাবি যেন এবারের বর্ষা মৌসুমের আগে স্থায়ীভাবে নদী ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং তার পাশে যেন স্থায়ী সড়ক নির্মাণ করে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে, উপজেলার কোটাকোল ইউনিয়নের তেলকাড়া গ্রামের শরিফা বেগম (৫০) জানান, তাদের পূর্বপুরুষের ১০০ বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন অন্যের জমি বর্গা চাষ করে পরিবারের সকলের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এ পর্যন্ত ৩ বার ভাঙনের শিকার হয়েছেন তাদের পরিবার। বর্ষা মৌসুম এলেই পরিবার পরিজন নিয়ে ভয়ের মধ্যে দিন পার করতে হয়। তিনি বর্ষা মৌসুমের আগে ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন।
তেলকাড়া গ্রামের হাসমত শিকদার (৭০) জানান, স্বাধীনতার পর থেকে শতশত পরিবার ভাঙনের কবলে পড়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে অন্য জায়গায়। অনেক আপনজন গ্রাম ছেড়ে কোথায় যে চলে গেছে তাদের খোঁজ জানা নেই। তাদের সাথে কখনও আর দেখা হবে কি না তাও তিনি জানেন না।
এ ব্যাপারে ভাঙন কবলিত তেলকাড়া গ্রামের বাসিন্দা রুব্বান বেগম (৪৫), রহিমা বেগম (৩৮), হেমায়েত মোল্যা (৪৪) ও সাবেক ইউপি সদস্য মাহাবুর রহমান (৬০) জানান, মধুমতী নদীর বারবার ভাঙনে তাদের বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। তাদের পুর্বপুরুষের ভিটেমাটি এখন নদীর ওপার গোপালগঞ্জ জেলার মধ্যে চলে গেছে। তাদের এসব জমি গুলো জবরদখল করে রেখেছে ওই এলাকার লোকজন। নদী ভাঙনে পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেছেন ওই সমস্ত পরিবার। গত বর্ষা মৌসুমে ভাঙতে ভাঙতে নদীর কিনারে চলে এসেছে তাদের বসতভিটা। শীত যাওয়ার পর বর্ষা মৌসুম চলে আসবে। আর তখন ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাবে। এবার বসতবাড়ি ভাঙলে আর মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে না তাদের। তাদের একটাই আকুতি, সরকারের পক্ষ থেকে যেন ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য নান্টু শিকদার জানান, মধুমতী নদীর ভাঙনে অসংখ্য বসতবাড়ি, আবাদি জমি,মাদ্রাসা,মসজিদ ভাঙনের শিকার হয়েছে। তিনি জানান কয়েক বছর আগে এই ওয়ার্ডে ১ হাজার ৭০০ ভোটার ছিল, সেটি কমে এখন ১ হাজার ভোটার আছে। ভাঙন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে যদি কোন ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, কয়েক বছরের মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে পুরো এলাকা। তিনি মধুমতী নদীর ভাঙন রোধে সরকারের দ্রুত সহযোগিতা কামনা করেন।
এ বিষেয়ে নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী (SDE) মো: শফি উল্লাহ বলেন, নড়াইল সীমানায় মধুমতী নদী ভাঙন কবলিত যে পয়েন্ট গুলো রয়েছে, ইতিমধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে ভাঙন রোধে ওইসব এলাকায় কাজ করা হবে। যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ করা যায় সে ব্যাপারে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে।