মোঃ তুষার আহমেদ:
‘শীতের শুরুতেই ঝাঁকে ঝাঁকে খাবারের সন্ধানে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়াসহ চলনবিলে ছুটে আসছে পরিযায়ী পাখিসহ দেশীয় নানা প্রজাতির পাখি। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠছে চলনবিলসহ আশপাশের এলাকাগুলো। এ সুযোগে সৌখিন ও পেশাদার শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে এসব পাখি নিধন শুরু করছে।
এদিকে,নানা প্রজাতির পাখি শিকার করে প্রকাশ্যেই বিক্রি করছে স্থানীয় হাট-বাজারে। তবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পাখি নিধন বন্ধে কাজ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে পাখি শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
গত বুধবার (১০ নভেম্বর) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলনবিল এলাকার খাল,বিল, নালা ও জলাশয়গুলোতে কমছে পানি। জেগে উঠছে খেত। পাওয়া যাচ্ছে ছোট বড় মাছ। বিলে বোনা আমন ধানও রয়েছে। এসব মাছ ও ধান খাওয়ার লোভেই নানা প্রজাতির পরিযায়ী ও দেশীয় প্রজাতির পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে এ অঞ্চলে। কিন্তু বিষটোপ, জাল ও ফাঁদ পেতে নির্বিচারে পাখি শিকার করছে শিকারীরা। এতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। পাখি নিধনে নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও উল্লাপাড়ার আলতাফ শেখ, শুকুর আলী, বেলাল খন্দকার, দুলাল আহমেদ, জুলমাতসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন কৃষক জানিয়েছেন, ফসলের জমিতে পানি দেওয়ার সময় মাটির নিচে থেকে উঠে আসা পোকামাকড়সহ খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাদা বক, শালিক, চড়ুই, ডাহুক, চ্যাগাসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি। এ সময় একশ্রেণির পাখি শিকারিরা পতঙ্গের ভেতরে বিষাক্ত কিটনাশক ঢুকিয়ে ছেড়ে দেয়। সেই পোকাগুলো খেয়ে পাখিরা মারা যায়। তখন পাখিগুলো ধরে কাছে রাখা ব্লেড, ছুরি দিয়ে জবাই করছে তারা।
কৃষকেরা আরও বলেন, চলনবিলের বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমির মধ্যে বড় বাঁশের সঙ্গে আকাশের দিকে উঁচু করে বড় ধরনের জাল পেতে রাখা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে পাখিদের তাড়া করলেই পাখিগুলো উড়তে গিয়ে জালে আটকা পড়ে। এই সুযোগে শিকারিরা পাখি ধরে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখছে। পরে সময়মত পাখিগুলোকে স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করছে।
স্থানীয়রা সুত্রে জানা গেছে, রাতচোড়া, টোগা, বালিহাঁস, পানকৈড়, পারিযায়ী পাখিসহ দেশীয় প্রজাতির অনেক পাখি। আর বর্তমানে চলনবিলের বিভিন্ন গ্রামে প্রতি এক জোড়া ভাড়ই বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা, প্রতি জোড়া বালিহাঁস ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, টোগা প্রতি জোড়া ৯০ থেকে ১১০ টাকা, রাত চোরা ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা প্রতি জোড়া, বক প্রতি জোড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অপরদিকে, চলনবিল অধ্যষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, নাটোরের সিংড়া,গুরুদাসপুর,পাবনার চাটমহর,ভাংগুড়া এলাকায় পাখি শিকার বন্ধে নিয়মিত কাজ করছে ‘চলনবিল জীব বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তবে স্থানীয় প্রশাসনের জোরালো কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় বন্ধ করা হচ্ছে না এসব পাখি শিকার।
চলনবিল জীব ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম স্বদেশ বার্তা ২৪ কে বলেন, চলনবিল এলাকায় ২০২০ সাল থেকে আমরা পাখি শিকারী বন্ধে কাজ করছি। আমরা মূলত পাখি শিকারিদের নিষেধ ও পাখি অবমুক্ত করে থাকি। এতে পাখি শিকারিরা ততটা ভয় পায় না। কয়েক বছরে প্রায় দুই হাজার শিকার করা পাখি উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছি। তবে প্রশাসন এ বিষয়ে একটু নজর দিলে কেউ আর অবাধে পাখি শিকার করতে পারবে না।
দি বার্ডস সেফটি হাউজের চেয়ারম্যান মামুন বিশ্বাস বলেন, চলনবিল অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবীরা পাখি রক্ষায় কাজ করছেন। তারা শিকার করা পাখি অবমুক্ত করলেও তৃণমূল পর্যায়ে জনসচেতনতার অভাব ও সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ের অভাবে এ বিলে স্থায়ীভাবে পাখি শিকার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
চলনবিলে অবাধে পাখি নিধনের বিষয়ে মুঠোফোনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, পাখি নিধন দণ্ডনীয় অপরাধ। খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য পরিযায়ী ও দেশীয় পাখি চলনবিলে আসে। এসব পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশকে রক্ষা করে।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,পাখি শিকার জীব বৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর। তবে কেউ যদি পাখি শিকার করে এবং পাখি হাট-বাজারে বিক্রি করে। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী,পাখি বা পরিযায়ী পাখি হত্যা অপরাধ। এ অপরাধের জন্য কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। তবে পাখি শিকারের তথ্য পেলে অভিযান পরিচালনা করে পাখি শিকার বন্ধের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নিয়ামুর রহমান।