নজরুল ইসলাম, জেলা প্রতিনিধি:
পোশাক তৈরির কারখানার শ্রমিক ও মালিকগণের পোশাকের কাঁচামাল এবং সরঞ্জামাদী প্রস্তুুত করতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রয়েছে সুতা, রঙের অভাব, কাঁচামালের অতিরিক্ত দাম, দক্ষ শ্রমিকের অভাবসহ নানা প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হচ্ছে। এর সঙ্গে সিন্ডিকেটের কারসাজি যুক্ত হয়ে এবার ডুবতে বসেছে সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্প।
সিরাজগঞ্জের তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গির চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। কিন্তু এই তাঁতিদের সুতা, রং ও কেমিক্যাল কিনতে হয় নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের আমদানিকারী মহাজন ও কটন মিলমালিকদের কাছ থেকে। আর এ দুই জেলায় এসব নিয়ন্ত্রণ করছে বড় কয়েকটি সিন্ডিকেট। বলা যায়, এই সিন্ডিকেটের ওপরই নির্ভর করে সিরাজগঞ্জের তিন লক্ষাধিক তাঁতির ভাগ্য।
সরকার প্রান্তিক তাঁতিদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড থেকে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। সেই সঙ্গে শুল্কমুক্ত সুবিধায় তাঁত বোর্ড নিবন্ধিত প্রাথমিক তাঁতি সমিতিকে সুতা, রং ও রাসায়নিক আমদানির ব্যবস্থা করা হয়।
এই সুযোগে প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে সুতা, রং ও রাসায়নিক আমদানি করতে থাকেন নারায়ণগঞ্জের সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ফজলুল হক, সুতা ব্যবসায়ী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ (বাবুল ভূইয়া) ও হাজি আব্দুস ছাত্তার। অথচ তারা কেউ তাঁতি নন। তাদের কারও কোনো তাঁত নেই।
এর পরও তাঁতিদের নেতা হয়ে গত দেড় বছরে ২২টি ভুয়া তাঁতি সমিতির নাম দিয়ে ৮০০ তাঁতির নামে বরাদ্দকৃত শুল্কমুক্ত সুতা আমদানি করে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে বিভিন্ন সুতার দোকানে কালোবাজারে বিক্রি করেছেন তারা। এই সুতা আমদানি করে কয়েক বছরে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে তৈরি করেছেন বহুতল ভবন।
এ অবস্থায় তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ একটি দল সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্প এলাকা পরিদর্শন করে প্রান্তিক তাঁতি ও প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এরপর শুল্কমুক্ত সুতা আমদানির নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়। নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড কর্তৃপক্ষ যথাযথ নিয়মনীতি (জারীকৃত এসআরও, ক্রাইটেরিয়া, সুপারিশ প্রদানের নীতিমালা) অনুসরণপূর্বক সুতা, রং ও রাসায়নিক আমদানির সুপারিশ দেয়।
মাঠপর্যায়ের লিয়াজোঁ কর্মকর্তার সুপারিশসহ তাঁতি সমিতির নামে সুতা আমদানির আবেদন করতে হবে, যা প্রথমে যাচাই-বাছাই করা হবে এবং আবেদন যথাযথ থাকলে প্রধান কার্যালয়ের সমিতি কর্মকর্তা নথি উপস্থাপন করতে হবে। পর্যায়ক্রমে তা সহকারী ব্যবস্থাপক, ব্যবস্থাপক, ডিজিএম, জিএম, মেম্বার হয়ে নথি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাতে হবে। চেয়ারম্যান তা অনুমোদন করলে জিএম চিঠি ইস্যু করবেন।
এরপর যে প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে শুল্কমুক্ত সুতা বরাদ্দ হবে, তা ওই অঞ্চলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে হস্তান্তর হবে। সুতা বিতরণের সময় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কাস্টমসের কর্মকর্তা, ব্যাংকের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিদের উপস্থিত থাকতে হবে। সবার সামনে প্রাথমিক তাঁতি সমিতির তাঁতিরা তাদের কেনা শুল্কমুক্ত সুতা নিয়ে যাবেন।
এরই ধারাবাহিকতায় সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৯টি সমিতির ১ হাজার ৫৮০ তাঁতির মাঝে সুতা, রং ও কেমিক্যাল বিতরণ করা হয়েছে। ফলে তারা এখন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম দামে কাপড় বিক্রি করতে পারছেন। ঠিক এই সময় নারায়ণগঞ্জের ফজলুল হক, মাহতাব উদ্দিন আহমেদ (বাবুল ভূইয়া) ও হাজি আব্দুস ছাত্তার বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের এই নীতিমালা পরিবর্তন চেয়ে আগের মতো করে শুল্কমুক্ত সুতা, রং ও কেমিক্যাল আমদানি ও বিক্রি করতে চান। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন। পাশাপাশি গত ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন।
সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, ‘আমাদের তাঁত নেই এখন। তবে আগে ছিল। আমরা প্রান্তিক তাঁতিদের নিয়ে কাজ করি। এই সুতা, রং ও কেমিক্যাল আমদানি করে স্বল্পমূল্যে তাঁতিদের মাঝে বিক্রি করি। এখন এই সুতা জাতীয় তাঁতি সমিতি নিজেরা আমদানি করছে। তাই দেশে আর কেউ আমদানি করতে পারে না। যে কারণে বর্তমানে বাজারে পলিয়েস্টার সুতার আমদানি নেই। সুতাসংকটে তাঁতিরা। আমরা এই নীতিমালা পরিবর্তন চাই।’
এ বিষয়ে সুতা ব্যবসায়ী হাজি সাত্তার বলেন, ‘আমি এই সমিতির কেউ না। আমার কোনো তাঁত নেই। আমি কোনো তাঁতির নামে সুতাও আনিনি। এ সম্পর্কে ফজলু আর বাবলু ভালো বলতে পারবেন।’
তবে মাহাতাব উদ্দিন আহম্মেদ বাবলু ভুইয়া বলেন, বর্তমানে তাঁত বোর্ডের জিএম ও সভাপতি দুজনে মিলে বিভিন্ন ওয়ার্ডের নামে কোটি কোটি টাকার সুতা, রং ও কেমিক্যাল বিতরণ না করে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করছেন। আমি এই বিতরণের নামে বিক্রি বন্ধ ও অবৈধ নীতিমালার পরিবর্তন চাই।’
এ বিষয়ে বর্তমান জাতীয় তাঁতি সমিতির সভাপতি মনোয়ার হোসেন বলেন, শুল্কমুক্তভাবে সুতা, রং ও রাসায়নিক আমদানি বন্ধ হলে দেশের বাজারে পলিয়েস্টার সুতার একচেটিয়া ব্যবসা ওই স্বার্থান্বেষী মহলটি করায়ত্ত করতে পারবে এবং পলিয়েস্টার সুতার দাম বহুগুণ বেড়ে যাবে। ফলে প্রান্তিক তাঁতিদের পক্ষে সুতা কিনে কাপড় উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ধসে পড়বে তাঁতশিল্প।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের জেনারেল ম্যানেজার কামনাশীষ দাস বলেন, তাঁতি সমিতির নামে সুতা আমদানির সুপারিশের ক্ষেত্রে কোনো একক কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই। সমন্বিত পদ্ধতিতে যথাযথভাবে ফাইল অনুমোদনের পরই চিঠি ইস্যু করা যায়। এখানে তাঁতবিহীন তাঁতিরা নেতা হয়েছেন। আর এই দুর্নীতিবাজরাই চালাচ্ছেন নানা অপপ্রচার।