( প্রসঙ্গ: রাসূল (ﷺ) এর প্রথম কথা, মা আমিনা ও দাদার ইন্তেকাল)
🟩 রাসূল (ﷺ) এর প্রথম কথা
হালিমাতুস সাদিয়া রা. বলেন, ‘আমি যখন নবিজিকে দুধ পান ছাড়াই, তখন তাঁর পবিত্র জবানে এ কথাগুলো উচ্চারিত হতো,
اللَّهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْدًا كَثِيرًا وَسُبْحَانَ اللَّهِ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
আল্লাহ সবচেয়ে বড় ও মহান। সব প্রশংসা আল্লাহর জন্যই। সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহ তাআলা সব ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে পবিত্র।(১৮)
শিশুবয়সে রাসূল (ﷺ) এর দৈহিক বৃদ্ধি অন্যান্য শিশুর চেয়ে অনেক ভালো ছিল। ফলে মাত্র দু-বছর বয়সেই তাঁকে বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখাত। তখন আমরা প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে নিয়ে যাই; কিন্তু তাঁর কল্যাণে প্রকাশিত নানাবিধ বরকতের কারণে তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে আমার মন মোটেই সায় দিচ্ছিল না। ঘটনাক্রমে সে বছর মক্কায় মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, ফলে আমরা একটা সুযোগ পেয়ে যাই। মহামারির অজুহাত দেখিয়ে আবারও তাঁকে আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসি। শিশু মুহাম্মাদ (ﷺ) পুনরায় আমাদের কাছে থাকতে লাগলেন। বাইরে যেতেন এবং ছেলেদের খেলাধুলা দেখতেন, তবে তিনি খেলতেন না; বরং চুপচাপ ও একাকী থাকতেন। মুহাম্মাদ (ﷺ) একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার অপর ভাইকে সারা দিন দেখতে পাই না, সে কোথায় থাকে?’ আমি বললাম, ‘সে বকরি চরাতে যায়।’ তিঁনি বললেন, ‘আমাকেও তাঁর সঙ্গে পাঠাবেন।’ এরপর থেকে মুহাম্মাদও তাঁর দুধভাই আবদুল্লাহর সঙ্গে বকরি চরাতে যেতেন।(১৯)
একবার তাঁরা উভয়ে বকরি চরাচ্ছিলেন। হঠাৎ আবদুল্লাহ দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে তার পিতাকে বলে, ‘সাদা পোশাক পরা দুজন লোক আমার কুরাইশি ভাইকে মাটিতে শুইয়ে তাঁর পেট চিরে ফেলেছে। আমি তাঁকে এ অবস্থায়ই রেখে এসেছি।’ আমরা স্বামী-স্ত্রী তখন ভীত-শঙ্কিত হয়ে মাঠের দিকে দৌড়াই। গিয়ে দেখি মুহাম্মাদ (ﷺ) বসে আছেন। তবে ভয়ে তখনো চেহারা বিবর্ণ হয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘বাবা, কী হয়েছে?’ তিনি বলেন, ‘সাদা পোশাক পরা দুজন লোক এসে আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন এবং আমার পেট চিরে তা থেকে কী যেন বের করলেন। আমি জানি না সেটা কী?’ তখন আমরা তাঁকে ঘরে নিয়ে আসি।(২০)
এরপর আমরা তাঁকে এক গণকের কাছে নিয়ে যাই। গণক তাঁকে দেখামাত্রই আসন থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁকে বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘হে আরববাসী, তোমরা কোথায়? দ্রুত এসো। যে বিপদ অচিরেই তোমাদের ওপর আসন্ন, সেটা প্রতিহত করো। এর পন্থা হচ্ছে, তোমরা এই শিশুকে হত্যা করে ফেলো এবং এর সঙ্গে আমাকেও হত্যা করো! আর যদি তোমরা তাকে জীবিত ছেড়ে দাও তবে স্মরণ রেখো, সে তোমাদের দীন নিশ্চিহ্ন করে দেবে এবং এমন এক দীনের প্রতি তোমাদের দাওয়াত দেবে, যার কথা তোমরা কখনো শুনোনি!'(২১)
গণকের কথা শুনে হালিমা রা. ভয় পেয়ে যান এবং নবিজি (ﷺ) কে সেই হতভাগার হাত থেকে ছিনিয়ে এনে বলেন, ‘তুই পাগল হয়ে গেছিস! আগে তোর নিজের মস্তিষ্কেরই চিকিৎসা করানো উচিত।’
এরপর হালিমা নবিজিকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসেন; কিন্তু এই দ্বিতীয় ঘটনাটি নবিজিকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে তাঁকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। কেননা, তাঁর ভয় হচ্ছিল, তিনি নবিজি (ﷺ) এর যথাযথ নিরাপত্তা দিতে পারছেন না।(২২)
হালিমা যখন নবিজি (ﷺ) কে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে যান, আমিনা তখন প্রশ্ন করেন, ‘এত আগ্রহের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসার কারণ কী?’ অনেক পীড়াপীড়ির পর হালিমা পুরো ঘটনা বলেন। আমিনা সব শুনে বলেন, ‘নিশ্চয় আমার ছেলের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।’ তখন তিনি তাঁর গর্ভাবস্থা ও প্রসবকালীন বিস্ময়কর ঘটনাগুলো তাঁকে শোনান।(২৩)
🟩 রাসূল (ﷺ) এর মা আমিনার ইন্তেকাল
নবিজির চার কিংবা ছয় বছর বয়সকালে তাঁর মা নিজের ভাইদের কাছে মদিনায় গিয়েছিলেন। সেখান ফেরার পথে ‘আবওয়া’ নামক স্থানে তিনি ইন্তেকাল করেন।(২৪)
বাল্যকাল। বয়স মাত্র ছয় বছর। পিতৃছায়া তো আগেই উঠে গেছে। এবার মাতৃছায়াও উঠে গেল। তবে এই ইয়াতিম শিশুটি যে রহমতের (আল্লাহর) আশ্রয়ে লালিত পালিত হওয়ার প্রতীক্ষায়, তিনি তো এসব উপায়-উপকরণের মুখাপেক্ষী নন।
🟩 রাসূল (ﷺ) এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের ইন্তেকাল
মা-বাবার পর নবিজি (ﷺ) তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিবের আশ্রয়ে লালিত পালিত হচ্ছিলেন; কিন্তু মহান আল্লাহর এটা দেখানো উদ্দেশ্য ছিল যে, এ বালক তাঁর রহমতের কোলেই প্রতিপালিত হবে। আল্লাহ নিজেই তাঁর লালনপালনের জিম্মাদার হয়েছেন।
নবিজির বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন পূর্ণ হয়, তখন দাদা আবদুল মুত্তালিব ও দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
টীকা :
(১৮) নবিজির প্রথম কথা এটাই। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত এ হাদিসটি ইমাম বায়হাকি রাহ, তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। খাসারিসুল কুবরা: ১/৫৫।
(১৯) শিশুবয়সেই নবিজি (ﷺ) এমন চাওয়া লক্ষণীয় যে, ‘আমার ভাই যেখানে কাজ করছে, সেখানে আমি কেন করব না?’
(২০) সিরাতু ইবনি হিশাম, হাশিয়া জাদুল মাআদ: ৮০; আল গায়াহ: ৮৯।
(২১) ইসলাম-পূর্ব যুগে কিছু লোক জিন বা শয়তানের মাধ্যমে আসমানি বিভিন্ন বিষয়াদির সংবাদ জেনে নিত এবং এর মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করত। বলত, ‘আমার কাছে গায়েবি সংবাদ রয়েছে।’ এদের গণক বলা হতো।
(২২) শাওয়াহিদুন নুবুওয়্যাহ ও খাসাইসুল কুবরা, মাওলানা জামি: ১/৫৫।
(২৩) ইবনু হিশাম: ৯।
(২৪) সিরাতে মুগলতাই: ১০।
লেখা :
বই – সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া ﷺ ; পৃষ্ঠা : ২৪-২৬
লেখক : মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.)
অনুবাদক : ইলিয়াস মশহুদ
চলবে ইনশাআল্লাহ …