আবুজর গিফারী,
বেড়া উপজেলা প্রতিনিধি।
এ যুদ্ধ ছিল বদর যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিহাসের গতিপথ নির্ণায়ক। এই যুদ্ধে বাগদাদের সুন্নি খিলাফত ধ্বংসের পর হতোদ্যম মুসলিম উম্মাহকে রক্ষার জন্যে মুসলিরা জীবনপণ লড়াই করে জয় ছিনিয়ে এনেছিল।
বাগদাদের সুন্নি হানাফি খিলাফতের নাম ছিল আব্বাসি খিলাফত। এই আব্বাসিরা ছিলেন আমাদের নবী (দ.)-এর চাচা আব্বাস (রা.)-র বংশধর, অর্থাৎ হাশমি। এই খিলাফতকে উচ্ছেদ করার জন্যে হাত মিলিয়েছিল হতোদ্যম ক্রুসেডার, তৎকালীন সুপার পাওয়ার প্রকৃতিপূজক মোঙ্গল হালাকু খান ও ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’ খলিফার রাফিজি (শিয়া) প্রধান উজির আহমেদ আল কামি (মিনহাজ ই সিরাজ তাঁর বই তবাকত ই নাসিরিতে বলেছেন রাফিজি, সৈয়দ আমির আলি তাঁর শর্ট হিস্ট্রি অব স্যারাসেনস বইয়ে বলেছেন শিয়া, সৈয়দ আমির আলি নিজে ছিলেন শিয়া) ও হালাকুর প্রধান পরামর্শদাতা ইসমাইলি শিয়া নাসিরউদ্দিন আত তুসি।
খলিফা মুস্তা’সিম বিল্লাহকে রাফিজি প্রধান উজির আল কামির চক্রান্তে বন্ধুত্বের ও সন্ধির ছলনা করে বন্দি করা হল। এই সময়ই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হালাকু সঙ্কটে পড়ে যান। তাঁর সভার রাজ জ্যোতিষ হুসামউদ্দিন বলেন খলিফাকে হত্যা করলে তার রক্ত মাটিতে পরলে এক বিশাল ভূমিকম্প মোঙ্গলদের গিলে খাবে। হালাকু প্রধান পরামর্শদাতা নাসিরউদ্দিনের দ্বারস্থ হলে সে বলে, এর আগে জাকারিয়া (আ.)-কে হত্যা করার সময় ভূমিকম্প হয়নি, নবী (দ.)-এর ইহলোক ত্যাগের সময় ভূমিকম্প হয়নি, হোসেন (রা.)-র অন্যায় হত্যার সময় ভূমিকম্প না হয়ে থাকলে কোনও আব্বাসীর হত্যার ফলে ভূমিকম্প কেন হবে ?
খলিফা মুস্তা’সিম বিল্লাহকে বলদের চামড়ায় ঢুকিয়ে পিটিয়ে হত্যা করলেও হুসামউদ্দিনের ভবিষ্যৎবাণী ফলে যায়। মাত্র ২ বছরের মধ্যে ১২৬০-এ আইন-ই-জালুত প্রান্তরে মিশরের মামলুক সুলতান আল মুজাফফর কুৎজের নেতৃত্বে,,,,খ্রিষ্টান সেনাপতি কাতবাগার ও মোঙ্গলদের যৌথবাহিনীকে সমূলে উৎখাত করেন। অচিরেই মোঙ্গলদের পূর্ব অংশ হয়ে যায় বৌদ্ধ ও পশ্চিমাংশ হয়ে যায় মুসলিম।
মোঙ্গল সেনাপতি বাগদাদের পর একে একে ইরাক ও সিরিয়ার বড় বড় শহরগুলি দখল করে লুঠপাট, গণহত্যা ও ধ্বংস দিয়ে শ্মশানে পরিণত করে। এমন হয় সমস্ত ইরাক-সিরিয়া-ফিলিস্তিন জুড়ে ইসলামের (পড়ুন সুন্নি ইসলাম) স্পন্দন প্রায় ছিল না। এই সময় ক্রুসেডার বাহিনীর পোয়া বারো, দেখে-শুনে তাদের আর আনন্দ ধরে না। হালাকুর খ্রিস্টান স্ত্রী এবং অন্যান্য নেস্টোরীয় খ্রিস্টান মুসলিমদের কাল্পনিক উচ্ছেদসাধনে উৎসাহের সঙ্গে কলকাঠি নাড়ে। আরমেনিয়ার রাজা হাতুন, সিরিয়া-ফিলিস্তিন এলাকার ত্রিপোলির ক্যাথলিক যুবরাজ ষষ্ঠ বোহেমন্ড, অ্যাকর, সাইপ্রাস ও টায়ারের যুবরাজরা হালাকুর খ্রিস্টান সেনাপতি কাতবাগার সঙ্গে হাত মিলিয়ে জেরুজালেম ও এশীয় এলাকার ইসলামের স্পন্দন সম্পূর্ণ মুছে দেওয়ার পরিকল্পনা করে, তার সঙ্গে জেনে না জেনে যোগ দিয়েছিল রাফিজিদের মতো ঘর শত্রু মীরজাফররা,, যাদেরকে বর্তমানে আমরা শিয়া কাফের হিসেবে জানি।
১২৫৯-এ মিশরের সিংহাসনে বসেন আল মুজফফার কুৎজ। তিনি মোঙ্গল+ক্রুসেডার+রাফিজি শিয়া কাফের বাহিনীর ধ্বংসলীলা দেখেন। এরপর হালাকুর ঔদ্ধত্যপূর্ণ চিঠি পান,‘ভালোয় ভালোয় আত্মসমর্পণ করুন নয়তো জেনেই গিয়েছেন বাকিদের অবস্থা কী করেছি, দেরি করলে দয়া ভিক্ষা করেও ক্ষমা পাবেন না’। কুৎজ ছিলেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ইসলাম মেনে চলা সুন্নি মুসলিম। তিনি তৎকালীন উলামা, শায়খ ও আধ্যাত্মিক সাধকদের সঙ্গে নিয়ে ১২৬০-এর রমযান মাসে গাজা পার হয়ে ক্রুসেডার বাহিনীকে আক্রমণ করলেন। আইন-ই-জালুত প্রান্তরে বহু গুণ বেশি মোঙ্গল-ক্রুসেডার বাহিনীর সম্মুখে বুক টান করে দাঁড়ালেন।
মোঙ্গলদের ছিল তৎকালীন শ্রেষ্ঠতম অস্ত্রসম্ভার, শ্রেষ্ঠতম যুদ্ধকৌশল। মুষ্টিমেয় মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে বদর প্রান্তরের মতই আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। ২৫-শে রমযান মুসলিমরা জুম্মার নামায আদায় করলেন তারপর শায়খ, আধ্যাত্মিক সাধকদের বিশেষ দোয়ায় বসিয়ে কুৎজ তীব্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। তাঁর নিজের ঘোড়া মারা গেলে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করলেন। রণক্ষেত্রে প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারালেন। চোখ মুছে স্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা ও মুসলিম রক্ষার উদ্দেশ্যে যে মরণপণ লড়াই লড়েছিলেন, তার ফলে মোঙ্গলরা পরাজিত হয়। শুধু সিরিয়া-ফিলিস্তিন নয়, অচিরেই ইরাক সহ আরব উপদ্বীপ থেকে বিতাড়িত হল মঙ্গল শয়তানেরা । বাদবাকিরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, এমনকি দিগ্বিজয়ী মোঙ্গলরা আর কোনদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
এরপর ক্রুসেডাররা শুধুমাত্র অ্যাকর কেন্দ্র করে আর মাত্র ৩১ বছর টিকেছিল তাও মামলুকদের দয়ায়। ১২৯১-এ মামলুকরা আরব উপদ্বীপ থেকে সমূলে উৎখাত করলে তারা সাইপ্রাসে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখান থেকেও সুন্নি ওসমানিয়া তুর্কিরা তাদের উচ্ছেদ করে। সেটা অন্য এক কাহিনি। অন্য একসময় জানানোর চেস্টা করবো। ইনশাআল্লাহ্।
ড. নাজির আহমেদ কথিত অ্যাসাসিনরা ইসমাইলি ফাতেমি শিয়া উদ্ভূত একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ছিল। এদের উচ্ছেদ করার জন্যে সমস্ত মুসলিম জগত মোঙ্গলদের সঙ্গে হাত মেলায়। তাই এরা একইসঙ্গে মুসলিম জগৎ ও মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের আহ্বান জানায়। তবে ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে এরা এলবুর্জের দুর্ভেদ্য দুর্গ থেকে উচ্ছেদ হয়। এরাই বাগদাদের দরসে নিজামি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মালিক শাহ সেলজুকের প্রধানমন্ত্রী নিযাম উল মুলককে গুপ্তহত্যা করে। নিজাম উল মুলক এই মাদ্রাসায় যে পাঠক্রম তৈরী করে দেন তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এখনও প্রতিটি মাদ্রাসায় ব্যবহার করা হয়। অ্যাসাসিন নামটি এসেছিল যেহেতু এই দলটি হাসিসের নেশায় বুঁদ হয়ে যাবতীয় হত্যা গুলি করত। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের সুন্নি খিলাফতকে উচ্ছেদ করলেও ১২৬১ তেই কায়রোকে কেন্দ্র করে আব্বাসী খিলাফত সম্মানজনক ভাবে ফিরে আসে সৌজন্যে মামলুক শাসকরা। মামলুক মানে দাস, একইসময়ে ভারতেও দাস বংশ মোঙ্গল আক্রমণকে প্রতিহত করে।
এখন কি মধ্যপ্রাচ্যে সেইরকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে না ? মার্কিন-রাশিয়ার মতো বৃহৎশক্তি, ইসরায়েল, ছদ্মবেশী ক্রুসেডার ও রাফিজিরা মজুত। এখন দেখা যাক, 1260-এর মতো বিজয়লাভ হয় কি না…?
 
        
 
                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
								                                                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                 
                                 
                                 
                                 
                                