রুপম চাকমা বাঘাইছড়ি উপজেলা
পাহাড়’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের জনজীবনে পরিচিতি প্রকৃতির অসাধারণ সৌন্দর্য, সবুজের সমারোহ ও মনোরঞ্জনের অন্যতম আকর্ষণ বিদ্যমান। কিন্তু এর বাইরে অন্যরকম এক কালো অধ্যায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। একদিকে পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলের অব্যবস্থাপনা, অন্যদিকে সামান্য মৌলিক অধিকার খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও শিক্ষা, যার একটিও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন অনুযায়ী আজ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হয়নি। সেই ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে পাকিস্তানের শাসন আমল, তারপর মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ঠিক একই নিয়মে একই পদ্ধতিতে শোষিত হচ্ছে। শোষণের পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু শোষণ কার্যকর রয়েছে।
বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের সম্পর্ক দুটো প্রথাগত চিন্তায় বিভক্ত। একটি জাতিগত, অন্যটি পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর শারীরিক গঠন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এই দেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু, তাদের সমতলের মানুষদের নিয়ে প্রথাগত চিন্তা তো দূরে থাক সমতল নিয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ঠাট্টা করার চিন্তাও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু সমতলের মানুষদের এমন চিন্তা কীভাবে গড়ে উঠল?
সমতলের মানুষদের এই চিন্তা দুটো প্রক্রিয়ায় তাদের মাঝে তৈরি করা হয়েছে। একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, অন্যটি ধর্মীয় ও জাতিগত প্রক্রিয়ায়। আর এই দুটো প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর শোষণ বিদ্যমান, সে শোষণকে কেন্দ্র করে চলছে রাজনীতি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জনজীবন ও সমতলের জনজীবন সম্পূর্ণ আলাদা। পাহাড়ের মানুষ সমতলের মানুষ থেকে কয়েকশ শতাব্দী পেছনে রয়েছে। সেটি করে রাখা হয়েছে।
অর্থাৎ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সাধারণ নাগরিক হিসেবে সামান্যতম যে অধিকার পাওয়ার কথা তা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। এই বঞ্চনার আর্তচিৎকার থেকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী দীর্ঘ যুগ আন্দোলন করছে পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে। যখনই পাহাড়ের সাধারণ মানুষ অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম ও লড়াই করেছে, তখনই এই সংগ্রাম ও লড়াইকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাহাড়ে অবস্থান করা বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে হত্যা, গুম, নির্যাতন ও নিপীড়ন করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৮০, ’৯২ ও ’৯৬ সালসহ নানা সময়ে সশস্ত্র হামলা, বাঙালি-পাহাড়ি দাঙ্গা, সেনাবাহিনী কিংবা আভিজাত্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পাহাড়ে অন্তত হাজার হাজার পাহাড়ি মানুষকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। গুম হতে হয়েছে। কল্পনা চাকমা গুম হয়েছেন আজ ২৭ বছর অতিক্রম হলো, এখনও কল্পনা চাকমা বেঁচে আছেন কি মরে গেছেন, কেউ জানেন না।
পাহাড়ে শান্তিচুক্তির নামে অঘোষিত সেনাশাসনও জারি করা হয়েছে। সেই শাসনের ভয়াবহতার চিত্র পাহাড়ির জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনের সংগ্রাম দেখলে অনুধাবিত হয়। বলা যায়, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী একটি আবদ্ধ চতুর্ভুজে বন্দি। তাদের প্রাত্যহিক বেঁচে থাকার লড়াই একটি স্বপ্ন। পাহাড়ের জনগণ যখনই বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করছে, তখনই পাহাড়ের একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে পাহাড়ের মধ্যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যার ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী জীবন-মৃত্যুর সুতায় ঝুলছে।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর রাতে পানছড়িতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা, পিসিপির সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের নেতা লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফ সদস্য রুহিন বিকাশ ত্রিপুরাকে হত্যা করা হয়। এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি প্রশাসন। এই ঘটনার রেশ না যেতেই বছরের শুরুতেই গত ২৪ জানুয়ারি দূরছড়ি গ্রামের নিজ বাড়িতে তিন ইউপিডিএফ সদস্য রবি কুমার চাকমা, শান্ত চাকমা ওরফে বিমল ও রহিন্তু চাকমা ওরফে ত্রিপল সেখানে অবস্থান করছিলেন। সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় রবি কুমার চাকমা ও শান্ত চাকমা (বিমল) মারা গেছেন। শুধু এ ঘটনাই নয়, পাহাড়ে আজ পর্যন্ত সংঘটিত কোনো ঘটনার সুস্থ তদন্ত কিংবা বিচার দৃশ্যমান হয়নি। পাহাড়ে এখন এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর চতুর্দিকে মৃত্যুকূপ। এ যেন এক টুকরো ফিলিস্তিন কিংবা ইউক্রেন।
বারবার প্রশ্ন উঠেছে সেনাবাহিনীর তৎপরতা নিয়ে। অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সেনাশাসন থেকে মুক্তি চায়, চায় সম্পূর্ণ পাহাড় সেনা, সন্ত্রাস ও দখলমুক্ত হোক। সে মুক্তির আকাক্সক্ষা থেকেই পাহাড়ের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর দাবি, পাহাড়ের অঘোষিত সেনাশাসন প্রত্যাহার করে অবিলম্বে পাহাড়ে শান্তি-শৃঙ্খলতা বজায় রাখার সুবিধার্থে পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে সরকারের উদ্যোগ এবং সেটির কার্যকর রূপান্তর। এই উদ্যোগ নিতে সরকার যদি কালক্ষেপণ করে, তাহলে ভবিষ্যতে পাহাড়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।