ইয়াছিন আলী ইমন
কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধিঃ
ছিল সাজানো-গোছানো সংসার। আয় রোজগারও ভালো হতো। প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে সুখেই দিন কাটতো আসাদুল হকের। কিন্তু হঠাৎ জীবনে নেমে আসে এক কালো অধ্যায়।দাম্পত্য জীবনে ঠুনকো বিষয়কে কেন্দ্র করে বাবার বাড়িতে চলে যান স্ত্রী। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া ছিল, আর ফিরে আসেননি। এ ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আসাদুল। পরে পরিবার থেকে দুই-দুইবার বিয়ে দিলেও কোনো স্ত্রীকে মেনে নিতে পারেননি।এরপরই বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। শেষমেশ তার পায়ে পরানো হয় লোহার শিকল। তখন থেকেই শিকল বন্দী হয় আসাদুলের জীবনযাত্রা।
আসাদুল হক (৩৫)।কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার তবকপুর সাদুল্যা সরকারপাড়া এলাকার দেলাবর মিয়ার ছেলে। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক দেলাবর। সহায় সম্বল বলতে সাত শতক বসতভিটার মালিক। পেশায় ক্ষুদ্র চা দোকানি। একমাত্র ছেলের এমন করুণ পরিণতিতে হতাশ তিনি।দেলাবর মিয়া বলেন, ‘চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে শিশুকালে এক ছেলে ও এক মেয়ে মারা যায়। বর্তমানে আসাদুল ও এক মেয়ে রয়েছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে এখন স্বামীর ঘরে। একমাত্র ছেলে আসাদুল দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করতে যায়। কয়েকমাস পর বাড়িতে ফিরে আসলে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের কয়েক বছর পর একদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হলে তার স্ত্রী বাবার বাড়িতে গিয়ে তালাকনামা পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু আসাদুল সেটা মানতে পারেনি। তখন থেকেই কিছুটা মাথার সমস্যা হয়। তারপর দুই দুইবার বিয়ে দিলেও কোনো স্ত্রী থাকেনি।এরমধ্যে আসাদুলের মা মারা যায়। এরপর থেকেই পুরোপুরি পাগল হন তিনি। বাড়িঘর ভাঙচুর, প্রতিবেশীদের জিনিস ক্ষতি করাসহ এবং দূর দূরান্ত ছুটে বেড়াত।তিনি আরো বলেন, ‘এর আগে কয়েকবার পায়ে শিকল লাগালেও মাঝে মধ্যে খুলে দেওয়া হতো। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে তার পায়ে শিকল লাগানো রয়েছে। আগের চেয়ে পাগলামির মাত্রাটা বেড়ে গেছে।দেলাবর মিয়া জানান, স্ত্রী মারা যাওয়ার প্রায় ১০ বছর হয়েছে। সংসারে বাপ আর ছেলে। ছোট চায়ের দোকান থেকে দিনে একশ থেকে ১২০টাকার মতো আয় হয়। তা দিয়েই কোনোরকম বাপ ছেলে খাই। মানুষের কাছে ধারদেনা করে রংপুরে ছেলেকে চিকিৎসা করাইছি। ডাক্তার কইছে (বলছে) ভালো হইবে। কিন্তু আমার ছেলে তো ভালো হয় না দাবি করেন তিনি।
এদিকে, প্রায় চার বছর ধরে শিকলে আটকে আছে হাবিবুর রহমানের (১৪) জীবন। হাবিবুর উলিপুর উপজেলার ধামশ্রেনী ইউনিয়নের পোদ্দার পাড়ার দিনমজুর আবুদ্দির ছেলে। ৬ বছর আগে আবুদ্দির স্ত্রী জোবেদা বেগম মারা যান। এরপর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করলে সৎ মায়ের সঙ্গে থাকে হাবিবুর। প্রতিদিন কাজে বের হওয়ার সময় হাবিবুরকে রাস্তার পাশে বাঁশ ঝাড়েশিকলে বেঁধে রেখে যান আবুদ্দি। রোদ বৃষ্টি মাথার উপর দিয়ে গেলেও তাকে যেন দেখার কেউ নেই।হাবিবুরের স্বজন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছর বয়সে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকে মানুষকে মারধর, বিদ্যুতের খুঁটিতে ওঠাসহ নানা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। মাঝে মধ্যে সবার অজান্তে দু-চারদিন করে নিরুদ্দেশ ছিল সে। পরে নিরুপায় হয়ে পায়ে শিকল পরিয়ে রাস্তার ধারে বাঁশ ঝাড়ে বেঁধে রাখা হয় তাকে। গরিব বাবার পক্ষে ভালো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভবনা হলেও স্থানীয় অনেক কবিরাজের ওষুধ খাইয়েছেন। তবুও হাবিবুরকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি বলেও জানান তারা।এ বিষয়ে উলিপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, তাদেরকে ইতিমধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। তবে এসব রোগীদের চিকিৎসার অর্থ সহযোগিতা করা যেতে পারে, কিন্তু সেটি প্রাপ্তি সাপেক্ষে।কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন কর্মকর্তা ডা. মো.মন্জুর-এ-মুর্শেদ বলেন,এসব রোগীদের শিকলে বেঁধে রাখা কোনো সমাধান নয়। তাদেরকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগী কোন পর্যায়ে আছে সেটি পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা করালে অনেক সময় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।