মোঃ আশরাফুল ইসলাম,মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি.
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন; আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চারবার সংসদ সদস্য।২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-৩ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই দল থেকে মনোনয়ন ভাগিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এমপি ও মন্ত্রী থাকাকালীন গড়েছিলেন নিজস্ব পেটুয়া বাহিনী। নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে হাতিয়েছেন হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে জাহিদ মালেক ও তার ছেলে-মেয়েদের নামে থাকা বিপুল সম্পদের তথ্য। এক মানিকগঞ্জেই এই পরিবারের নামে থাকা ছয় হাজার ৫৩ শতাংশ জমির তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি।
দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করে জানায়, সম্প্রতি জেলার সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিলো। সেই চিঠির জবাবে তাদের নামে ছয় হাজার ৫৩ শতাংশ জমির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।যাতে দেখা যায়, মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন মৌজায় কেনা এসব জমির মধ্যে জাহিদ মালেকের নামেই রয়েছে দুই হাজার ১৯৩.০৫৩ শতাংশ। তার ছেলে রাহাত মালেকের নামে এক হাজার ৭৪২.০১৬ শতাংশ এবং এক হাজার ১১৮.৭৮ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে মেয়ে সিনথিয়া মালেকের নামে।
সূত্র আরো জানায়, মানিকগঞ্জে জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে যে ছয় হাজার শতক জমি ছেলে রাহাত মালেকের নামে ৯১টি দলিল, মেয়ে সিনথিয়ার নামে ২২টি এবং জাহিদ মালেকের নামে রয়েছে ৪৬টি দলিল।
গোপন সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রী থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালের কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইক্যুইপমেন্ট, ওষুধ সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়নমূলক কাজে ভাগ বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জাহিদ মালেক।আওয়ামী লীগের শাসনামলে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন জাহিদ মালেক।তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকার গুলশানে আলিশান বাড়ি, বনানীতে ১৪ তলা বিটিএ টাওয়ার, মানিকগঞ্জ শহরে ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন, সভা-সমাবেশ করার জন্য গড়েছেন শুভ্র সেন্টারসহ নানা স্থাপনা।
জানা যায়, ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সানলাইফ বিমা কোম্পানিটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। তার বোন রুবিনা হামিদের আগে তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এই প্রতিষ্ঠানেও তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। যার কারণে সারাদেশের লাখ লাখ গ্রাহক বিমার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরও একটি টাকা পাননি। এ নিয়ে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা করেছেন গ্রাহকরা।
এদিকে, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিরীক্ষিত হিসাব অনুসারে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ১৯২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। অর্থাৎ আইন অনুসারে কোম্পানিটি ব্যবসা পরিচালনায় যে ব্যয় করতে পারে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। অতিরিক্ত ব্যয় করা এসব টাকার ৯০ শতাংশই বিমা গ্রাহকের জমাকৃত টাকা। এ কারণে গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারেনি সানলাইফ বিমা কোম্পানিটি ।
অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট দুদকের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) মানিকগঞ্জে কারখানা স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প পাস হয়েছিল। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি পাস হয়। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৭ সালের মার্চ পর্যন্ত। প্রকল্পের জন্য মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের মেঘশিমুল এলাকায় সাড়ে ৩১ একর জমি প্রস্তাব করা হয়। যেসব মৌজায় এসব জমি পড়েছে তার অধিকাংশই সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার ছেলে-মেয়েদের নামে। কিছু জমি মেয়ের স্বামীর নামেও দানপত্র করা হয়েছিল।প্রকল্প পাসের পর অধিগ্রহণ হলে তিন গুণ দামে জমিগুলো বিক্রি করতে পারবেন, এমনটা পরিকল্পনায় ছিল তাদের। এতে সরকারের ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে বলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আবদুল লতিফ। এর জের ধরে তাকে অপসারণের জন্য জাহিদ মালেকের ফুপাতো ভাই শামীম মিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলনও হয় । পরে প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়।
জানা যায়,সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে করোনার টিকা, কিট, নকল মাস্ক বানিয়ে ও ভুয়া আমদানি দেখিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। এমনকি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালের ক্রয়, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইকুইপমেন্ট, ওষুধ সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়নমূলক কাজে ভাগ বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামা সূত্রে জানা যায়, এই সময়ে তার আয় ও সম্পদ উভয়ই বেড়েছে।২০০৮,২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট অথবা অন্যান্য ভাড়া, ব্যবসা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ব্যাংক আমানত ও অন্যান্য বাবদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বার্ষিক আয় আট কোটি ২৯ লক্ষ ৯৭ হাজার ২৫ টাকা,যা ২০০৮ সালে ছিল ৭১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৬৯১ টাকা। সেই হিসেবে গত ১৫ বছরে তার বার্ষিক আয় বেড়েছে ৭ কোটি ৫২ লক্ষ ৬২ হাজার ৩৩৪ টাকা। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে তার বার্ষিক আয় বেড়েছে ১১.৬৩ গুণ। ২০১৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী তার বার্ষিক আয় ছিল দুই কোটি ২০ লক্ষ ৮৩ হাজার ২১১ টাকা। সে হিসেবে গত পাঁচ বছরে তার বার্ষিক আয় বেড়েছে ছয় কোটি ৯ লক্ষ ১৩ হাজার ৮১৪ টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে তার বার্ষিক আয় বেড়েছে ৩.৭৫ গুণ।
২০১৮ সালে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪২ কোটি ২৪ লক্ষ ৪৬ হাজার ৫৭১ টাকা। সেই হিসেবে গত পাঁচ বছরে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ২৮ কোটি ৯ লক্ষ ২০ হাজার ৯০ টাকা, অর্থাৎ ১.৬৬ গুণ বেশি।
এদিকে গুঞ্জন উঠেছে চলতি বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের।সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের আগেই ব্যাংককে পাড়ি জমিয়েছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।জানা গেছে গত ১৪ জুলাই বারিধারা প্রেসিডেন্ট পার্ক রোডের বাসা থেকে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ব্যাংককে চলে যান তিনি।