মোঃ আশরাফুল ইসলাম , মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি.
জীবনের প্রতিটি গল্পই যেন একেকটি মহাকাব্য। তবে কিছু গল্প আছে, যা অন্য সবার মাঝে আলাদা হয়ে দাঁড়ায় — কারণ সেই গল্প লেখা হয় অদম্য সাহস, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর অশেষ পরিশ্রম দিয়ে। তেমনি সংগ্রামের পথ বেয়ে উঠে আসা মানিকগঞ্জের ছেলে মো. শরীফ হোসেন আজ অনেক তরুণের অনুপ্রেরণা।
শরীফের জীবনের প্রথম অধ্যায়েই নেমে আসে শোকের ছায়া। দেড়-দুই বছর বয়সে মাকে হারান ক্যান্সারে। মাত্র তেরো বছর বয়সে ছায়া হারান বাবার। কিন্তু এতিম হয়ে যাওয়া তিন ভাই–বোনের সবচেয়ে ছোট এই সন্তান থেমে যাননি কখনো।
★ বাবার কষ্ট দেখেই স্বপ্ন বড় হয়েছিল
কৃষিজীবী বাবার কষ্ট ছিল তাঁর প্রতিদিনের বাস্তবতা। জমিতে কাজ করার সময় বাবা একমুঠো ভাত আর পানি নিয়ে মাঠে যেতেন, ছোট্ট শরীফকে পাশে বসিয়ে সারাদিন কাজ করতেন। নতুন জামা–কাপড়ের লোভ ছিল না বাবার, ছিল শুধু একটি স্বপ্ন—
“আমার শরীফ মানুষ হবে, শিক্ষিত হবে।”
★ শিক্ষকদের ভালোবাসায় এগিয়ে চলা
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক—প্রতিটি ধাপে শিক্ষকরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। ভালো ফল করায় পেয়েছেন বৃত্তি, পেয়েছেন সবার স্নেহ। মাধ্যমিকের বোর্ড পরীক্ষা দারুণ ফল করেছিলেন, কিন্তু বাবা সেটি দেখে যেতে পারেননি।
এরপর ভর্তি হন মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কারণে প্রাইভেট পড়তে না পারলেও কলেজের শিক্ষকেরা তাঁকে আদর করতেন, দিকনির্দেশনা দিতেন। শতভাগ উপস্থিতির জন্য পেয়েছিলেন বিশেষ স্বীকৃতি।
★ অভাব–অনটনের মাঝেও থেমে যায়নি শিক্ষা
উচ্চমাধ্যমিক শেষে অনার্সে ভর্তি হলেও চলছিল অর্থকষ্ট। পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ ছিল চাকরিতে যাওয়ার—একমাত্র উপায় যেন উঠে দাঁড়ানোর। কিন্তু শরীফ থামেননি। রাজমিস্ত্রি, কৃষিকাজ, প্লাম্বিং—যে কাজ পেয়েছেন করেছেন, শুধু পড়াশোনা আর স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
এ সময় মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেন মোজাম্মেল হোসেন মোল্লা। তিনি শুধু থাকার আশ্রয়ই দেননি, দিয়েছেন সাহস, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা।
★ পরপর ব্যর্থতা, তারপর সফলতার আলো
সরকারি চাকরির জন্য ১৮টি ভাইবা দিয়েছেন—কোথাও হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট, বিমানবাহিনী, ডিসি অফিস—অনেক জায়গায় ব্যর্থতা এসেছে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি।
অবশেষে ১৯তম ভাইবায় বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকরি পান। সিলেটে যোগদানের পরও থেমে থাকেননি—পূর্ণ করেন গ্রাজুয়েশন।
এর আগে তিনি বাংলাদেশ আনসার ব্যাটালিয়নেও চাকরি করেছিলেন। যে হাসপাতালে একসময় বাবাকে ভর্তি নিতে চায়নি, সেই পিজি হাসপাতালে তিনিই চাকরি করেছেন। ডিউটি করে ভোরে এসে পরীক্ষা দিয়ে আবার কাজে ফিরে যেতেন—সংগ্রাম ছিল নিরবচ্ছিন্ন।
★ সব কিছু অর্জন, তবু শূন্যতা একটিই
আজ তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। জীবনের কষ্ট জয় করে, স্বপ্ন পূরণ করে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।কিন্তু তাঁর হৃদয়ে এখনও একটি হাহাকার— “বাবা মা দেখে যেতে পারলেন না! …”
★ তরুণদের জন্য এক অনুপ্রেরণা
মো. শরীফ হোসেন আজ প্রমাণ করেছেন—স্বপ্ন শুধু বড় হওয়া নয়, স্বপ্ন পূরণ করাও সম্ভব, যদি ইচ্ছে শক্তি থাকে, সাহস থাকে। শত কষ্টের মাঝেও যার জীবন চলে গেছে, তাকেও হার মানায়নি সংগ্রাম।
তাই তিনি আজ হাজার তরুণের কাছে অনুপ্রেরণার প্রতীক — হার না মানা এক মানুষ।

