বিপ্লব সাহা, খুলনা ব্যুরো:
একুশ মানে রক্তে ভেজা একখন্ড মাটির উপর দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলা, একুশ মানে অধিকার আদায়ের পালাবদল করা।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে আজ থেকে ৭৩ বছর আগে ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলা মায়ের বীর সন্তানেরা বুকের রক্তে রঞ্জিত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল। তাই ১৯৫২ সালে আজকের এই দিন একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্টি হয়েছিল মাতৃভাষার জন্য আত্ম বলিদানের অভূতপূর্ব নজির। ফলে মাতৃভাষার জন্য বাঙালির বীর সন্তানদের অকুণ্ঠিত আত্মত্যাগে এক অনন্য ঘটনা স্বীকৃতি হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো।সেহেতু আজ বাংলাদেশের সাথে সারা বিশ্বে সমাদৃতভাবে এই দিনটি পালিত হচ্ছে। তাই গভীর রাত বারোটা এক মিনিটে ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে নগ্ন পায়ে পুষ্পার্ঘ হাতে নিয়ে সমবেত কন্ঠে একই সুরে গেয়েছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি বেদনা ভরা বিস্মিত হলেও সুমধুর সুর সারা বিশ্বব্যাপী তথা প্রকৃতিকে জানান দিচ্ছে আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের আজকের এই দিনে মায়ের মুখের বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে রাজপথে নামা কিছু তরুণের বুকের তাজা রক্তে লাল হয় ঢাকার রাজপথ।
সেদিন মাতৃভাষা রক্ষার জন্য বাংলার দামাল ছেলেরা তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। আর তাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। এরপর থেকেই ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে দিনটি। পরবর্তীতে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিতে পেয়ে যথাযথভাবে সারা বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
আর তারই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা থেকেই সাজতে শুরু করে শহীদ মিনার। একুশের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ রাত ১২ টা ১ মিনিটে কালো ব্যাজ ধারণ করে দেশের সকল জেলা উপজেলা থানা পর্যায়ে স্কুল কলেজ প্রাঙ্গণের শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন সর্বস্তরের মানুষ। জানা গেছে, বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের দিনটি পালনে ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রীয়ভাবে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। এরই মধ্যে দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস ও রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, পাশাপাশি জাতীয় দিবস হিসেবে দিনটিতে সরকারি ছুটি রয়েছে।
একই সাথে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আঙ্গিকে ভাষা শহীদদের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে।
বাংলা আমার মায়ের ভাষা বাংলা আমার মুখের ভাষা ওরা আমার মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। প্রতিবাদী বাঙালি সালাম রফিক সালাম বরকত সহ নাম না জানা আরও অনেক শহীদ বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দুরলব্ধ বাংলা ভাষাকে শ্রদ্ধাভরে বরণ করে নিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও লাখো মানুষ অংশ নিয়েছে প্রভাতফেরিতে। তাছাড়া দিবসটির উপলক্ষে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও শোকের কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য সংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে মাসব্যাপী একুশে বইমেলা সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনের রয়েছে।
তাছাড়া ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। এর আগে, ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টন ময়দানে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন- পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কেবল উর্দুই হবে । ফলে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে স্বীকৃতি দেয়া হবে । ’ আর ঠিক সেই মুহূর্তে খাজা নাজিমুদ্দিনের এই একটি ভাষণই ভাষা আন্দোলনের অগ্নি লেলিহান ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙলার ছাত্র-শিক্ষক-জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষ। এবং তাৎক্ষণিকভাবে অবিসংবাদিত নেতা মওলানা হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
এবং মাওলানা ভাসানির নির্দেশে মুহূর্তের মধ্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় ধর্মঘটসহ বিক্ষোভ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। এরই প্রেক্ষিতে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। এক পর্যায়ে ছাত্রদের দৃঢ়তায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ঢাকার পলাশীর আমতলায় বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সম্মুখ সড়কে এসে পৌঁছাতেই নির্বিচারে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় পাকিস্তানি পুলিশ এতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেকে। এরপর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ভাষা আন্দোলন। আর এই আন্দোলন ক্রম অন্যায় অগ্নি দাবানলের রূপ ধারণ করে পাকিস্তানি পরাশক্তিকে বশীভূত করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় ছাত্র জনতা।