খুলনা জেলা প্রতিনিধিঃ
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) গঠিত হয়েছে ফ্যাসিস্ট স্টাইলের টেন্ডার সিন্ডিকেট, হচ্ছে দৈনিক মুজুরী ভিত্তিক বা মাস্টাররোল বা লেবার নাম দিয়ে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ বাণিজ্য। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাসুদ নিয়োগ পেয়েছেন পাঁচ মাসও পার হয়নি। এ সময়ের মধ্যেই অস্থায়ী ভিত্তিতে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন ৪২ জনকে, যাদের অনেকেরই বয়স ৩০ পেরিয়ে গেছে। এছাড়াও, পুরাতন দুটি ভবন ভেঙে বিক্রির জন্য ৩৫ লাখ টাকার দরপত্র নির্ধারণ করা হলেও উপাচার্য সিন্ডিকেট করে নিজের ঘনিষ্ঠজনদের ২৪ লাখ টাকায় এ কাজ দিয়েছেন। এসব তিনি করছেন চারজন কর্মচারীর মাধ্যমে, যারা তার ‘চার খলিফা’ নামে পরিচিত। এদেও মধ্যে দুইজনকে নতুন উপাচার্যের আমলে কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই চার খলিফার রয়েছে একজর আধ্মাত্মিক গুরু। যিনি কিছুদিন পূর্বে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন এবং উপাচার্যের পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পূর্ববর্তী উপাচার্য পদত্যাগ করলে বিশ্ববিদ্যালয়টির অষ্টম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাসুদ।
এদিকে প্রায় সাড়ে সাত বছর আগে অন্যের টেকনিক্যাল পেপার নকল করে প্রকাশ ও বিদেশে এক সম্মেলনে উপস্থাপন করার অভিযোগে কুয়েট সিন্ডিকেট কর্তৃক শাস্তি পান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাসুদ।
অভিযোগে উঠেছিল, ২০০৪ সালে মিতসুবিশি মোটরসের টেকনিক্যাল রিভিউতে (নম্বর-১৬) প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধের প্রায় শতভাগ নকল করে মুহাম্মদ মাছুদসহ তিন শিক্ষক ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ভলিউম-২ ইস্যু-১) এবং আইসিএমআইএমই ২০১৩-এ দুটি টেকনিক্যাল পেপার প্রকাশ করেন। ওই গবেষণাপত্রের বিষয়বস্তু, ফলাফলসহ অন্য লেখকের গবেষণার সঙ্গে প্রায় শতভাগ মিল ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তদন্ত কমিটি তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সিন্ডিকেটের ৫৮তম সভায় অধ্যাপক মাছুদসহ তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই সিন্ডিকেটের ৬২তম সভায় তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি তিন বছরের জন্য স্থগিত এবং পাঁচ বছরের জন্য উচ্চতর স্কেল স্থগিত করা হয়। শাস্তি হয় অন্য দুই শিক্ষকেরও।
ডাটা প্রসেসর পদে নিয়োগ পাওয়া মো. মনিরুজ্জামান যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকলেও কর্মচারী থেকে হয়ে যান কর্মকর্তা। নিয়োগের প্রতিটি ধাপে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন মনিরুজ্জামান। ফলে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের অডিট আপত্তিতে উঠে আসে নিয়োগ আর পদোন্নতিতে অনিয়মের তথ্য। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা অডিট শাখা ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষায় তৎকালীণ সহকারী রেজিস্ট্রার মো. মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্তে¡ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়োগ প্রদান করায় বেতন হিসেবে নেওয়া ৫৫ লাখ ৫৪ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০০৬ সালে সহকারী সেকশন অফিসার পদের নিয়োগের সময়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ঘাটতি থাকায় মনিরুজ্জামানের নিয়োগ বাতিল করারও সুপারিশ করা হয়েছে এ অডিট প্রতিবেদনে। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্যের আপত্তি উপেক্ষা করে নিজ ক্ষমতাবলে তাকে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে পদোন্নতি দিয়েছেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাসুদ। এছাড়া, পূর্ববর্তী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে মো. মনিরুজ্জামান মেতে ওঠেন নিয়োগ বাণিজ্যে। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সিন্ডিকেট করে করেছেন নিয়োগ বানিজ্য। স্ত্রী ও আপন ছোট ভাইয়ের চাকরির পাশাপাশি নিজেও কর্মচারী থেকে হয়ে যান কর্মকর্তা। সব উপাচার্য়ের আমলেই বাগিয়ে নেন প্রোমোশন, হয়ে যান আস্থাভাজন এবং অনিয়মের দোসর।
তবে নবনিযুক্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, যা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মেনেই হয়েছে। তার স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের চাকরিতে তার কোনো প্রভাব নেই বলেও দাবি করেন মনিরুজ্জামান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুয়েট এখন চলে চার খলিফার ইশারায়, যার প্রধান হলেন এমদাদুল হক ওরফে এমদাদ মোড়ল। স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা হিসেবে কুয়েটে সবকিছুর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন তিনি। ডাটা প্রসেসর হলেও পদোন্নতি নিয়ে হয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। দ্বিতীয়জন জালাল মুন্সী। অফিস সহায়ক থেকে একেবারে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়েছেন তিনি। বাকি দুজন ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট আশরাফুল আলম ও অফিস সহায়ক সাইফুলও একধাপ পদোন্নতি নিয়েছেন বর্তমান উপাচার্য মুহাম্মদ মাসুদ যোগদানের পর। এই চার খলিফার আধ্মাত্মিক গুরু হলেন মাসখানেক পূর্বে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া উপাচার্যের পিএস মোঃআব্দুর রহমান।
২০১৮ সালে সরকারি দপ্তরে অস্থায়ী ও মাস্টাররোল কর্মচারীদের নিয়োগ না দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও যোগদানের মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে ৪২ জনকে কোনো প্রকার দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য। নিয়োগ বানিজ্যের মাধ্যমেই অধিকাংশ কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির পুরাতন ১৬ ও ১৭ নম্বর ভবন দুটি ভেঙে বিক্রির জন্য নিলাম দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিলাম কমিটি। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দুটি ভবনের নিলামের বুক ভ্যালু নির্ধারণ করা হয় ১৭ লাখ ৫ হাজার ৯৭৭ টাকা করে মোট ৩৫ লাখ ১ হাজার ৯৫৪ টাকা। এই টেন্ডার সিন্ডিকেট করে নিজের এবং পিএস মোঃআব্দুর রহমান এর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী মীর কায়সেদ আলীর মালিকানাধীন মেসার্স আর কে এন্টারপ্রাইজকে দুটি ভবন ২৪ লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন উপাচার্য। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ লাখ টাকার ক্ষতি হয় ।
এসব অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাসুদ বলেন, ‘সরকারি আইন মেনে ভবন দুটি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে।’ কর্মচারী নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি আইন রয়েছে মাস্টাররোল নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে কিছু মানুষকে দৈনিক মজুরিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছি। এখানে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়নি।’