মোঃ আশরাফুল ইসলাম.
একসময় মানুষ পড়তে কিংবা লিখতে জানত না।ছিলনা বোঝার ভাষা । তবু মানুষের মনে ছিল না প্রতারণার এত ফন্দি-ফিকির।কেউ রাগ বা হিংসা অনুভবও করত না। লিখতে-পড়তে বুঝতে না পারা এসব মানুষ কতইনা সহজ-সরল ছিল। কেউ কাউকে ঠকানোর, কাউকে কষ্ট দেওয়ার মনোভাব পুষে রাখত না।
এখন মানুষ পড়তে শিখেছে, লিখতে শিখেছে।শুধুকী তাই?; বই-খাতার পাতা ছেড়ে লিখতে শিখেছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, টুইটার,ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে। বাংলিশ, ইংরেজী সব রকমের লিখতে শিখে গিয়েছে। সঙ্গে রপ্তও করে ফেলেছে একাধিক নারী বা পুরুষে কীভাবে আসক্ত থাকা যায়। এখন আর সেই অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত ছেলে বা মেয়েটির মতো একনজর প্রিয়কে দেখে শুভ্রতার প্রেমে হারিয়ে যাওয়ার লেশ নেই। সময়ের সাথে পাল্টেছে যুগ । সহজেই মানুষকে সব রকম ফাঁদে ফেলার কৌশল রপ্ত করছে মানুষ।
জন্মের পর থেকে শিশু মা-বাবার কাছ থেকে যে শিক্ষা পাচ্ছে, তা নিয়ে সে বড় হচ্ছে। তার পারিবারিক মূল্যবোধ তার ওপর প্রভাব ফেলছে। কোনো পরিবারে মা বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তার মনের ওপর প্রভাব ফেলছে। সবাইকে নিয়ে গড়ে ওঠার শিক্ষা সে পাচ্ছে না। আজ যখন বড় বড় ডিগ্রি নিয়েও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ না হয়ে বড় বড় দুর্নীতিতে যুক্ত হচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে শিক্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে কেন অসততা প্রশ্রয় পাচ্ছে। শিক্ষিত হয়েও তারা নিজেকে সুশিক্ষিত করতে পারেনি কেন? উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও যখন মানুষ বিনয়ী, অহংকারমুক্ত হয়, তখন তাকে জ্ঞান অর্জনের পথিক বলা যায়। জ্ঞানের ধর্মই বিনয়ী করা। আবার সুশিক্ষার কাজও তাই। যা মানুষকে মনুষ্যত্বের পথ দেখায়।
যেহেতু শিক্ষা একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মনীষীরা যাকে বলেন মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন কারও পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না, তেমনি একটি জাতিও শিক্ষা বা সুশিক্ষা ছাড়া মাথা উঁচু করে বিশ্বসমাজে দাঁড়াতে পারে না।
শিক্ষার নামে কুশিক্ষা এবং নীতি নৈতিকতাবিহীন শিক্ষার কারণে সুশিক্ষা পাচ্ছেন না কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরের শিক্ষকের বিরুদ্ধে আসছে শিক্ষাকে বাণিজ্যে পরিণত করা, ছাত্রী ধর্ষণ-নিপীড়ণ, আর্থিক কেলেঙ্কারি, গবেষণায় জালিয়াতি, প্রশ্নফাঁস, দলবাজীসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ। এতে ক্লাসে সুশিক্ষার অভাবে পথভ্রষ্ট হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তৈরি হচ্ছে কিশোর অপরাধী। মদ,গাঁজা,ইয়াবা,হেরোইন মাদক ও কিশোর অপরাধসহ নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা। শিক্ষার এই বেহাল অবস্থার কারণে শিক্ষকদের সমীহ করার বদলে উল্টো বিতর্কিত হচ্ছেন।
দুঃখ হলেও সত্য; সদ্য প্রাইমারি শেষ করা বাচ্চারাও জড়িয়ে পড়ছে নানা রকম অপকর্মে। তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। যৌথ পরিবার ভেঙে হয়ে গিয়েছে একক পরিবার। বলা হয়ে থাকে, এখন নাকি মানুষ এক-দুজনও এক ছাদের নিচে একসঙ্গে বসবাস করতে পারছে না। মা-বাবা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে ফেলে আসার ঘটনা অহরহ ঘটছে। বাচ্চারা আজকাল খেলাধুলা ভুলেই গিয়েছে স্মার্টফোন ও গ্যাজেটের আসক্তিতে। অধিকাংশ মা-বাবাও কান্না থামাতে বা খাবার খাওয়াতে শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন গ্যাজেট ।
দুর্নীতি, ধর্ষণ, অন্যের অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি ত্রাণ দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ না করা, ক্ষমতাধর ব্যক্তির পরিচয়ে নানা জায়গায় নানা সুবিধা হাসিল ইত্যাদি আজকাল সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার করছে। ঘটছে অপহরণ, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, খুনের মতো জঘন্য ঘটনা। কৃষক, শ্রমিক, মজুর পাচ্ছেন না ন্যায্য মূল্য। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সিন্ডিকেটের জাঁতাকলে পিষ্ট আজ সমাজ।
শিক্ষিত জাতি একটি সমাজের সম্পদ। কিন্তু সেটা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তখন সে সমাজ কখনো একটি দেশকে এগিয়ে নিতে পারে না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। অথচ একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা গেলে অন্যসব সমস্যার সমাধান করা একেবারেই সহজ হয়ে যায়।
জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী জাতীয়ভাবে এখন এ দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ।ইউনিসেফের তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালে আমরা যখন স্বাধীনতা লাভ করি, তখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। সেই হিসাবে আমরা এখন শিক্ষায় বিরাট এক অগ্রগতি লাভ করেছি। এই যে শিক্ষার হারের উচ্চগতি, তারপরও সমাজের নানা স্তরে দেখা যায় নৈতিকতাবোধের বিপুল ঘাটতি। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ১৬.৮ শতাংশ শিক্ষিত নাগরিকের একটি সমাজ সেই সময় এদেশ স্বাধীন করার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিতে কার্পণ্য করেনি। আর এখন ৭৪ শতাংশ শিক্ষিত মানুষের সমাজে এমন একটি সংগ্রাম দরকার পড়লে কতজনকে পাওয়া যাবে? সংগ্রামের কথা তো দূরে থাক, এখন ভালো কাজে রাজি হওয়ার লোকই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
দেশে শিক্ষার হার জিপিএ ৫, স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডির ছড়াছড়ি; কিন্তু সুশিক্ষিত মানুষ সেভাবে দেখতে পাচ্ছি না। বরং মানুষ এখন যত শিক্ষিত হচ্ছে, কীভাবে যেন ততই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠছে! মেধাবী নয়, তারা হয়ে উঠছে একেক জন চালাক-চতুর। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। গুণগত মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত হলে এ প্রজন্মের নাগরিকরা নৈতিকভাবে শক্তিশালী হতো। দেশে অন্যায়-অপরাধ কমত। কিন্তু সে-রকম দৃশ্য তো দেখা যাচ্ছে না। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, নিশ্চয়ই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট আছে, সমস্যা আছে। আর চারদিকে চোখ মেলে তাকালেই এই সংকটের তীব্রতা আমরা আঁচ করতে পারি।
মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জিনিসটাই এখন উঠে গেছে। পরস্পরকে ঠকানোর এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে মানুষ। এদের বেশিরভাগই কাগজে-কলমে সনদধারী, শিক্ষিত। যারা যত বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠছে, তারা যেন তত বেশি চালাক হয়ে উঠছে। প্রতারণার ষোলোকলা রপ্ত করাই যেন শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য হয়ে উঠছে। দুর্নীতি করার জন্য যে শক্তি বা যোগ্যতা দরকার, সেটিই যেন তারা অর্জন করতে শিক্ষা নামের অস্ত্রের দ্বারস্থ হচ্ছে।
এই যে নৈতিকতার অধঃপতন, এই যে আদর্শহীনতা, এখান থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে পারছে না বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং গবেষকরা বলছেন, আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক এখনকার বিশ্বে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত জ্ঞান সৃষ্টি ও টিকে থাকার কোনো উপায় খোঁজার সহায়ক নয়। শৈশব থেকেই অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে থাকায় একসময় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই শিক্ষার যথোপযুক্ত পরিবেশও। এমন অবস্থার মধ্যেই নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় কাজের সুযোগ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠছে একেকটি হতাশা সৃষ্টির কারখানা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন করে কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না।
শিক্ষার্থীরাই জাতির ভবিষ্যৎ। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে কোনো কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি না করলে সেটি জাতির ভবিষ্যৎও তৈরি করবে না। অতিরিক্ত, অযৌক্তিক, অবাঞ্ছিত সিলেবাসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া জিপিএর লোভ থেকে বের হতে হবে। শিক্ষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। যেটি এ দেশে হারহামেশা ঘটছে। এখানে শিক্ষার্থীদের নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাধ্যগতভাবে গতানুগতিক ভালো ফলাফল এলেও এই শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন কিংবা রাষ্ট্রের কী কাজে লাগবে তা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই জানে না। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষায় তৈরি হয়েছে চাকরির বাজারের অনিশ্চয়তা। যার দরুণ ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার্থীরা আত্মহননের মতো পথও বেছে নিচ্ছে।
আজ যেমন অনেক ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে সার্টিফিকেট অর্জন করেও মনুষ্যত্বের পথ দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেই শিক্ষা সমাজের বা দেশের কোনো কাজেই আসছে না, বরং ব্যক্তির ভোগলিন্সায় যাচ্ছে তাকে সুশিক্ষা বলা চলে না। বিপরীতে কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ না করেও নিজের বিবেক, আদর্শ নিয়ে সমাজে সততার চর্চা করলে তাকে সুশিক্ষিত বলা চলে। এদের দ্বারাই সমাজের দেশের ও দশের মঙ্গল।
শিক্ষিত হওয়া আর মনুষ্যত্ব অর্জন করা এক কথা নয়, দুটো সম্পূর্ণই ভিন্ন। আমরা পরিশ্রমের মাধ্যমে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করতে পারছি তবে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারছি না। মানুষই একমাত্র জীব যার মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য চর্চার প্রয়োজন হয়। মনুষ্যত্ব অর্জনের চর্চাটাই আমাদের সমাজে তথা পরিবারে নেই। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষের চিন্তা-ভাবনাই উচ্চবিলাসী। শিক্ষিত হয়ে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে বড় কোনো অফিসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখি আমরা।
আমাদের শিক্ষিত হওয়ার উদ্দেশ্যও এমনটাই। আসলে আমরা বাবা, মায়েরা পরিবার থেকেই আমাদের শিশুদের মনে এমন একটা স্বপ্নের বীজ বপন করে দিচ্ছি। ভাবতেই অবাক লাগে আমরা নিজ হাতে আমাদের সন্তানদেরকে টাকা উপার্জনের মেশিন হিসেবে তৈরি করতে মরিয়া হয়ে ছুটছি কিন্তু তাদের মানবিক শিক্ষার দিকেই নজর দিচ্ছি না।
সব ধর্মেই ভালো কাজের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় দূর করতে সভা ও সেমিনার করতে হবে, বাড়াতে হবে সচেতনতা। যোগ্য ও সৎ লোককে দায়িত্বশীল স্থানে বসাতে হবে। তবেই সমাজভাঙনের এই তীব্র অসুখ দূর করা সম্ভব হবে। অন্যথায় সমাজে অপকর্মের হার বেড়েই চলবে।