মশিউর মিলন, পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধি:
পটুয়াখালীর বাউফলে ভূমি জরিপের ২কোটি টাকার অধিক ঘুষ বানিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতি খতিয়ানের (পর্চা) বিপরীতে নেয়া হয়েছে ১হাজার থেকে ৭০হাজার টাকা পর্যন্ত। আর এসকল ঘুষ বানিজ্যে সহযোগিতা করছেন সর্দার আমিন মো গিয়াস উদ্দিন, অফিস সহকারী মন্টু মিয়াসহ স্থানীয় দালাল চক্র। তবে এবিষয়ে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন স্থানীয় জমি মালিক। কারণ কর্মকর্তাদের সরসারি সহযোগিতা করছেন স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা।
জানা গেছে, ১৯৫৪ সালের পর বাংলাদেশের দক্ষিণের জনপদ বাউফলে ভূমি জরিপ হয়নি। দীর্ঘ ৭০বছর পর বাউফলে চর দিয়ারা কচুয়ার ২৩টি মৌজায় জরিপ কাজ শুরু করে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ (সেটেলমেন্ট) অধিদপ্তর। ৯৮সালে একটি জরিপ হয় কিন্তু সেটি ত্রæটিপূর্ণ হওয়ায় আবার জরিপটি পুনরায় চলমান আছে। মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ করে উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের শৌলা মৌজায় চলছে এ্যাটেষ্টেশন বা তসদিক কার্যক্রম। একাজে শৌলা মৌজায় দায়িত্বে ছিলেন কর্মকর্তা (কানুনগো) মো খলিলুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান (কানুনগো)। তাদের কাজে সহায়তায় ছিলেন সর্দার আমিন মো গিয়াস উদ্দিন, অফিস সহকারী মন্টু মিয়া। এর পর ৩০ধারার অভিযোগের শুনানী এবং সর্বশেষ ৩১ ধারার আপিলের শুনানি শেষে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হবে প্রকৃত জমি মালিককে।
বাউফল ভূমি অফিসের দেয়া তথ্যমতে, ভূমি জরিপ সম্পূর্ণ সেটেলমেন্ট অফিসের (বরিশালের) কাজ। এর সাথে বাউফল অফিসের কোন যোগসূত্র নেই। এই জরিপের কাজ করবেন একজন কানুনগো ও সার্ভেয়ার। তবে এটাই শেষ জরিপ এরপর থেকে ডিজিটাল জরিপের কাজ শুরু হবে। ৩০ধারায় যারা অভিযোগ করতে পারবেন না তারা ৩১ ধারায় কোন অইনী সহায়তা পাবেন না। কারণ ৩১ধারার অভিযোগ গুলোর সমাধান না হলে সেগুলোই ৩১ধারার মাধ্যমে পুঃন তদন্ত করে অভিযোগের সমাধান দেয়া হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে যদি কোন গ্রাহক ভুলেও ৩০ধারা মিস করেন তবে সে তার জমি হারানোর সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এ জরিপের গেজেট পাশ হতে ৪/৫ বছর সময় লেগে যেতে পারে বলেও জানান তারা। গেজেটের পর আবার ল্যান্ডট্রাইবুনাল বা দেওয়ানী আদালত বসবে। সেখানেও ভুলত্রটির উপর অভিযোগ দাখিল কারা যাবে। গেজেট পাশ হওয়ার পর আইনী সহায়তা নিতে অদালতের দারস্থ হতে পারবে। সেক্ষেত্রে জরিপে বন্দোবস্ত পাওয়া ব্যক্তিরাই এগিয়ে থাকবেন।
কিন্তু মাঠ পর্যায়ে জরিপে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেন জমি মালিকরা। নিজস্ব পৈতিৃক সম্পত্তির মালিকানা ফিরে পেতেও বড় অংকের টাকা গুনতে হচ্ছে প্রত্যেককে। টাকা লেনদেন করছেন সার্ভেয়ার গিয়াসউদ্দিন যিনি কাকুনগো খলিলুর রহমানের সহকারী হিসেবে তার টেবিলে কাজ করছেন। স্থায়ী ভাবে জমি হারানোর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না স্থানীয়রা। অপরদিকে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ। অন্যদিকে কেউ মুখ খুললে জমির রেকর্ড অন্যের নামে হয়ে যাবে বলে ভয় দেখান স্থানীয় দালালরা।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কানুনগো মো. খলিলুর রহমানের দেয়া তথ্যমতে, শৌলা মৌজার দিয়ারা জরিপে ৮০৮৫টি খতিয়ানের (পর্চা) জরিপ কাজ সম্পন্ন করে ‘দিয়ারা সেটেলমেন্ট অপারেশান অফিস’ বরিশাল। নকশা তৈরি কাজ শেষে শুরু হয় এ্যাটাস্টেশন বা তসদিক কাজ। তসদিক কাজে মোট ১হাজার ৮৪টি পর্চা বা খতিয়ানের উপর ডিসপুট (আপত্তি) দেয়া হয়।
জমি মালিকদের অভিযোগ, প্রতিটি পর্চা তসদিক করতে একেক জনের কাছ থেকে সর্বনি¤œ ১হাজার করে টাকা নেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে ৮হাজার ৮৪টি পরচার জন্য ১হাজার করে প্রায় ৮১লাখ টাকা হাতিয়েছেন ওই ভূমি জরিপ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। প্রথমে মাঠ পর্যায়ে জমির নকশা তৈরির কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। মূল সমস্যা তৈরি হয় এই মাঠ পর্যায়ের নকশা তৈরিতেই। নকশার মাধ্যমে একজনের জায়গা অন্যজনকে মালিকানা ঘোষণা করা হলে শুরু হয় টাকা লেনদেন। টাকার বিনিময়ে জমি ফেরৎ পেতে দৌড়ঝাপ শুরু করেন জমি মালিকরা। নকশা তৈরিতে অনেক রাজনৈতিক নেতাদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নকশা তৈরি কাজ শেষে শুরু হয় এ্যাটাস্টেশন কাজ। এতে মোট ১হাজার ৮৪টি পর্চায় ডিসপুট দেয়া হয়। ডিসপুট পর্চার কাজ করতে প্রতিটি গ্রাহককে গুনতে হয়েছে ২হাজর থেকে ৫০হাজার টাকা পর্যন্ত। সর্বনি¤œ ২হাজার করে ১হাজার ৮৪টি খতিয়ান পর্চায় মোট ২১লাখ ৬৮হাজার টাকা আদায় করেছেন গ্রাহকদের কাছ থেকে। তবে এসকল গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের টাকা গ্রহণ করেছেন ওই কর্মকর্তা। ৩০হাজার থেকে ৭০হাজার টাকা পর্যন্ত গেছে গ্রাহকের পকেট থেকে। এক্ষেত্রে নকশা পরিবর্তনে কত টাকার লেন দেন হয়েছে সেটা নিরুপন করা সম্ভব হয়নি। কারণ, নকশার ক্ষেত্রে যারা লাভবান হয়েছেন তারা কোন ভাবেই মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে বড় অংকের টাকা লেন-দেন হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। রয়েছে ৩০ধারার শুনানী। টাক লেনদেন সেখানেও যে হবে তা অনুমেয়। এরপর ৩১ধারায় আপিল। যত উপরে দিকে যাবে তত টাকর পরিমান বাড়তে থাকবে। গত ৩০জুন এ্যাটাস্টেশন কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এখন অপেক্ষা ৩০ধারার অভিযোগের শুনানী।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ জরিপ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে শৌলা মৌজার গ্রাহকদের কাছ থেকে অনুমানিক ২০কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। আর টাকা লেনদেনে সর্দার আমিন গিয়াসকেই দায়ি করেছেন সবাই। এছাড়া রয়েছেন মাইনুদ্দি, মোফাজ্জেল মাওলানা ও ইমদাদ নামের কয়েকজন দালাল। এসব দালালরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে নিরাপদে টাকা পয়সার লেনদেন চালিছেন।
মঞ্জুরুল আলম নামের এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ৩দফায় ৬০হাজার টাকা নিয়েছেন গিয়াস। কিন্তু তার পরেও আমার কাজ করে দেননি। আমার বাড়ির চলাচলের রাস্তা আমার প্রতিবেশির নামে রেকর্ড করে দিয়েছেন আরও বেশি টাকার বিনিময়।
কালাইয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ শৌলা গ্রামের আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ৪০হাজার টাকা নিয়েছে গিয়াস। কিন্তু একই বাড়ির অপর এক ব্যক্তি পৈতিৃক ভাবে দেড় শতক জমির মালিক অথচ টাকার বিনিময়ে ওই দাগের ৭শতক জমি পুরোটা তার নামে রেকর্ড করে নিয়েছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (কবির হাওলাদার) এক ব্যক্তি জানান, জরিপে যে পরিমান টাকা তারা (কর্তৃপক্ষ) কামিয়েছে তা গুনতে ওদের এক বছর সময় লাগবে। জমি মালিকরা তাদের গাছ, মাছ বিক্রি করে টাকা দিয়েছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কানুনগো সিদ্দিকুর রহমান ও সর্দার আমিন মো গিয়াস উদ্দিন। তারা কালবেলাকে বলেন, প্রতিটি খতিয়ান বা পর্চার কাজ করে দিয়েছি, বিনিময়ে ভূমি মালিকরা আমাদেরকে চা-পান খেতে কিছু দিয়েছে। তবে সেটা পরিমান কি তা স্বীকার করতে রাজি হননি তারা।
এবিষয়ে দিয়ারা সেটেলমেন্ট অপারেশন বরিশাল বিভাগীয় চার্য কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ভূমি জরিপে কোন ফি বা টাকা লাগে না। এরপর তিনি সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর বলেন আমি এখন ব্যস্ত আছি। কথা ভাল বুঝতেছিনা। আপনাকে পরে ফোন করবো। তিনি আর ফোন করেননি।